র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিকের অভিমত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বিভিন্ন দার্শনিকের র্যাডিক্যাল নারীবাদ সম্পর্কিত মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, র্যাডিক্যাল নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিকগণ যে মতামত প্রদান করেছেন তা উল্লেখ কর।
অথবা, র্যাডিকেল নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের মতামত লিখ।
অথবা, বিভিন্ন দার্শনিকদের র্যাডিক্যাল নারীবাদ বিষয়ক মতামত সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
উদারপন্থি নারীবাদ সমাজসংস্কারের মাধ্যমে নারীমুক্তিতে বিশ্বাসী। র্যাডিক্যাল নারীবাদ সংস্কারে বিশ্বাসী। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রচলিত অসম ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা উৎপাটিত করে একটি সুখম, সমতাপূর্ণ, সহযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা প্রতিস্থাপন ব্র্যাডিক্যাল নারীবাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। র‍্যাডিক্যাল নারীবাদী প্রবক্তারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা বিশেষত বিদ্যমান সেক্স বা জেন্ডার ব্যবস্থা বহাল রাখার ঘোরতর বিরোধী। কারণ তাঁদের মতে, এ ব্যবস্থা নারী নির্যাতনের প্রধান ও মৌলিক হাতিয়ার। গুণগত ও পরিমাণগত উভয়দিক দিয়ে নারী নির্যাতনের শিকারকে যে দুঃখকষ্ট দেয় অন্যকোন ধরনের নির্যাতনের সাথে তার তুলনা হয় না। নারীনির্যাতন অন্যান্য নির্যাতনের চেয়ে বহুগুণ মর্মান্তিক।
র্যাডিক্যাল নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিকের মতবাদ : নারীবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন র‍্যাডিক্যাল তাত্ত্বিকের ধারণা পাওয়া যায়। যদিও র্যাডিশাল নারীবাদী প্রবক্তাগণ একমত যে, সমাজ সৃষ্ট যৌন ভূমিকা পরিপূর্ণ মানবিক
সত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বিকাশে প্রতিবন্ধক। নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে নারীসুলভ ও পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যের একত্র সমাবেশ। তথাপি তাদের মধ্যে মত ও পথের বিভিন্নতা বিদ্যমান। বিভিন্ন তাত্ত্বিকের র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ।সম্পর্কিত ধারণা নিম্নরূপ :
ক. কেন্ট মিলেটের অভিমত : নারী নির্যাতনের শিকড় পিতৃতন্ত্রের সেক্স বা জেন্ডার ব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত। কেন্ট মিলেট র‍্যাডিক্যাল নারীবাদ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেগুলো নিম্নরূপ :
১. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ : পুরুষের প্রাধান্য তথা পুরুষসুলভ ভূমিকা এবং নারীর অধস্তন তথা নারীসুলভ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ নারী ও পুরুষের মধ্যে জৈবিক পার্থক্যগুলোকে অতিরঞ্জিত করে। পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ এমন শক্তিশালী যে, পুরুষ নির্যাতিত নারীর আপাত সম্মতি নিয়েই যেন নারীর উপর নির্যাতন চালায়। সাহিত্য, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, বস্তুত জ্ঞানের সকল শাখা নারীর পুরুষ অধীনতা সমর্থন ও জোরদার করে। ফলে নারী নিজ হীনতাকে আত্মস্থ করে এবং প্রতিবাদ করে না।
২. যৌন সম্পর্ক : মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডের যৌনতা সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা আপাতদৃষ্টিতে প্রগতিশীল মনে হলেও আসলে এর উদ্দেশ্য নারী পুরুষের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক প্রদর্শন করা। এ প্রসঙ্গে Millet বলেছেন, নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্বেষজনক সম্পর্কের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা, ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার অনুমোদন দেয়া এবং নারী পুরুষের
মেজাজের তফাৎ বৈধ করা।
৩. নারী পুরুষের সমতা : প্রতিক্রিয়াশীলদের বাচালতায় কেউ দমে যাননি। Talcot Parsons দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেছেন যে, বিংশ শতাব্দীর জাগ্রত ও সংঘবদ্ধ নারীবাদ নারী নির্যাতনের চাবিকাঠি সেক্স বা জেন্ডার ব্যবস্থা ধ্বংস করবে। নতুন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে জীবনের সকলক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ হবে সমান, সমমর্যাদাসম্পন্ন। কেন্টের স্বপ্নের নতুন সমাজের ভিত্তি হবে স্ত্রী সমতা Androgyny নতুন সমাজ হবে Androgynous উভলিঙ্গ। নতুন সমাজ গঠিত হবে নারী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যে নারীসুলভ ও পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে।
৪. সমন্বয় সাধন : কেন্ট এ সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়ায় সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে চান। কারণ সকল বৈশিষ্ট্য নির্বিচারে সমন্বয় সঠিক হবে না। প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন করতে হবে এবং যেগুলো সমাজকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে, কেবল সেগুলো বেছে নিতে হবে। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে প্রত্যেক নারী পুরুষ সর্বোৎকৃষ্ট নারীসুলভ ও সর্বোৎকৃষ্ট
পুরুষসুলভ গুণে গুণান্বিত হয়ে সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবে।
খ. গুলামিথ ফায়ারস্টোনের অভিমত : গুলামিথ কেন্টের তুলনায় উগ্রপন্থি। কেন্টের সাথে অবশ্য তিনি একমত যে, প্রজননে নারী পুরুষের ভূমিকার মধ্যে নারী অধীনতা ও পুরুষের প্রাধান্যের আদর্শিক ভিত্তি নিহিত। তাঁর মতে, বড় রকমের জৈবিক ও সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন। নিম্নে গুলামিথ ফায়ারস্টোনের অভিমতকে বর্ণনা করা হলো :
১. জৈবিক বিপ্লব : জৈবিক বিপ্লব হতে প্রজননের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক (গর্ভস্থ) প্রজননের পরিবর্তে কৃত্রিম প্রজনন চালু করতে হবে। সামাজিক বিপ্লব হতে হবে পরিবারের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের লক্ষ্যে। নারী ও পুরুষ নিয়ে গঠিত পরিবারের স্থলে নারী পুরুষের পরস্পরের পছন্দ, বন্ধুত্ব বা সুবিধার লক্ষ্যে এক বাসের জন্য এ পরিবার গড়ে তুলতে হবে।
২. কৃত্রিম প্রজনন : ওলামিথ বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে এবং প্রজননের সাথে সম্পর্কহীন নারী- নারী, পুরুষ-পুরুষ, পুরুষ-নারী পরিবার গঠিত হলে, পুরুষের পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য ও আচরণ প্রদর্শনের এবং নারীর নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য ও আচরণ প্রদর্শনের আবশ্যকতা লোপ পাবে। জীববিজ্ঞানের নিয়মে প্রজননের ভূমিকা থেকে নারীমুক্তি লাভ করবে। ফলে মানবগোষ্ঠীর বংশবৃদ্ধির চাকা সচল রাখার জন্য নারীকে সক্রিয় পুরুষের অধীনে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে না।
গ. মেরীলিন ফ্রেলের অভিমত : মেরীলিন জীববিজ্ঞান তথা প্রকৃতিকে আংশিক এবং সামাজিকীকরণ তথা পালন পোষণকে আংশিক দায়ী করেছেন। মেরীলিন ফ্রেন্সের অভিমতকে নিম্নলিখিতভাবে ব্যক্ত করা যায় :
১. নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন : নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন থেকে আধিপত্যের অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোর সূচনা হয়েছে। নারীর উপর পুরুষের আধিপত্যের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা সম্ভব হলে সকল ধরনের আধিপত্য ন্যায্য গণ্য করা সম্ভবপর। এ প্রসঙ্গে Marilyn-French তাঁর ‘Beyond Power on Women, Men and Morals’ গ্রন্থে বলেছেন, নারীর উপর পুরুষের স্তরবিন্যাস সকল শ্রেণির স্তরবিন্যাসের সূচনা করে। একটি অভিজাত শ্রেণি জনগণের উপর আধিপত্য করে।
২. আধিপত্যমূলক ক্ষমতা (Power over) : আধিপত্য তথা প্রাধান্যের পিছনে চালিকাশক্তি হলো প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা, যাকে মেরীলিন ফ্রেন্স বলেছেন, Power over বা আধিপত্য। Power over মূলনীতি পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি, কাজেই পিতৃতন্ত্রের বিশ্ব পুরুষসুলভ বিশ্ব, যেখানে সকল ক্ষমতা একটি পুরুষসুলভ গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত থাকে।
ঘ. মেরি ডেলীর অভিমত : মেরি ডেলী মেরীলিনের এক ধাপ উপরে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোকে৷প্রচণ্ড আক্রমণ করেছেন এবং তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপাদন করেছেন। তবে তিনি Androgyny বা স্ত্রী সমতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, পিতৃতন্ত্র কঠোর পুরুষসুলভ ও নারীসুলভ জেন্ডার ভূমিকাকে পরিণত করে মানব সম্প্রদায়কে দ্বিধাবিভক্ত করেছে এবং পুরুষ Second sexরূপে নারীকে কল্পনা করতে শিখেছে। কাজেই androgynous বা উভলিঙ্গ ব্যক্তি সৃষ্টি করতে না পারলে পিতৃতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্ট জেন্ডার অচলায়তন ভেঙে ফেলা যাবে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসে নারীই সর্বপ্রথম নির্যাতিত গোষ্ঠী, অন্যান্য গোষ্ঠীর নির্যাতনের আগে নারীনির্যাতন শুরু হয়েছে। নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি, কারণ স্থান, কাল নির্বিশেষে সকল সমাজে নারীনির্যাতন প্রচলিত আছে। নির্যাতনের এত ব্যাপক দৃষ্টান্ত আর নেই। নারী পুরুষের মধ্যে নারীসুলভ ও পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যের একত্র সমাবেশ অর্থাৎ, Androgyny প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়, কিন্তু তথাপি তাদের মধ্যে মত ও পথের বিভিন্নতা বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন র্যাডিক্যাল ব্যক্তিত্বের মতামত আলোচনার অপেক্ষা রাখে। এরা হলেন, কেন্ট মিলেট, শুলামিথ ফায়ারস্টোন, মেরীলিন ফ্রেন্স ও মেরি ডেলী উল্লেখযোগ্য। র‍্যাডিক্যাল নারীবাদের উদ্ভবের ফলে বিশ্বের নারী নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে উল্লিখিত তাত্ত্বিকদের আলোচনায়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*