রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার অবদান আলোচনা কর।
অথবা, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কে? তার সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি বহুজাতিক দ্বীপ রাষ্ট্র হলো শ্রীলঙ্কা। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা হলেন এ দ্বীপ রাষ্ট্রটির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা উদার চিন্তা চেতনাসম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি উচ্চাভিলাষী, ব্যক্তিত্ব ও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতীক। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের উন্নয়ন ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁর আদর্শবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্মোদ্যোগ এসব কিছুর মধ্যেই পাওয়া যায় এক মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয়। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কুমারাতুঙ্গার অসামান্য অবদান রয়েছে। প্রশ্নানুসারে এসব ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আলোচনার পূর্বে
আমরা তাঁর পরিচয় সম্পর্কে একটু জেনে নেব।
সংক্ষিপ্ত পরিচয় : শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হলেন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। সলোমন বন্দরনায়েকে এবং শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের তিন সন্তানের মধ্যে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা হলেন তাঁদের বড় সন্তান। চন্দ্রিকার পিতামাতা উভয়ই অলংকৃত করেছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ। কাজেই দেখা যায় যে, তাঁর শরীরে রাজপরিবারের রক্ত প্রবাহিত। চলচ্চিত্র নায়ক
বিজয়া কুমারাতুঙ্গার সাথে চন্দ্রিকা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে অবশ্য চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার স্বামী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং নায়ক থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হন। বিজয়া-চন্দ্রিকা দম্পতির দুই পুত্রসন্তান হলেন যশোদারা (Yasodara) এবং ভিমুক্তি (Vimukti)। চন্দ্রিকার স্বামী বিজয়া ১৯৮৮ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড : নিম্নে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. শ্রীলঙ্কার পিপলস পার্টি গঠন : চন্দ্রিকা এবং তার স্বামী সত্তর দশকের শেষের দিকে শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি থেকে বিভক্ত হয়ে যান। এরপর তারা শ্রীলঙ্কা মহাজন পার্টি (SLMP) অর্থাৎ, শ্রীলঙ্কা পিপলস্ পার্টি গঠন করেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তামিল যুদ্ধের সাথে তাদের এ নতুন দলের অস্তিত্ব সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এরই ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে তাঁর স্বামী ১৯৮৮ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর চন্দ্রিকা অবশ্য তাঁর এবং দুই পুত্রের জীবনের নিরাপত্তার জন্য দেশত্যাগ করে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। যাহোক, তাঁর উদ্যোগেই শ্রীলঙ্কা পিপলস্ পার্টি গঠিত হয়েছিল।
২. প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন : চন্দ্ৰিকা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৯২ সালে। দেশে ফিরে তিনি মুমূর্ষু প্রায় শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। পশ্চিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের চীফ মিনিস্টার হিসেবে তিনি ১৯৯৩ সালের মে মাসে নির্বাচিত হন। এরপর পাঁচ দলীয় জোট পিপলস্ এলায়েন্স (Peoples Alliance) থেকে ১৯৯৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা এলায়েন্স প্রধান হিসেবে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
৩. রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা : রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের অর্থ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো দুটি বৃহৎ মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখে তিনি তা দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন ।
৪. ভূমিসংস্কার : চিন্তাচেতনার দিক দিয়ে চন্দ্রিকা উদার মনের পরিচায়ক। তাঁর মায়ের দ্বিতীয় শাসনকালে তিনি স্বদেশে ফিরে এসে ভূমিসংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর মার্কসীয় দর্শনের প্রভাব দ্বারা তিনি এ কাজে উদ্বুদ্ধ হন। দেশের বড় বড় ভূস্বামীদের তো বটেই এক্ষেত্রে তিনি নিজ পরিবারকেও ছাড় দেন নি। যদিও এক্ষেত্রে সিন্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন কিন্তু এ সমালোচনা তাকে দমিয়ে দিতে পারে নি।
৫. তামিল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে : ক্ষমতা প্রাপ্তির সাথে সাথেই চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা তামিলদের দেশব্যাপী সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা তামিলদের প্রতি ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আন্তরিকতার প্রমাণই রেখেছেন। ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট তিনি উত্তরাঞ্চলে তামিল অধ্যুষিত এলাকায় দ্রব্যসামগ্রী আদানপ্রদানের ব্যাপারে সকল প্রকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ১৯৯৫ সালের ৮ জানুয়ারি কুমারাতুঙ্গার সাথে তামিলদের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় শান্তি ফিরে আসবে বলে অনেকে আশাবাদী হয়ে উঠেন। আর কুমারাতুঙ্গা পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলেন সাফল্যজনকভাবে। হঠাৎ করেই দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল “Liberation of Tamil Tiger Eaelm” এর গেরিলারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি বাতিল ঘোষণা করে। Liberation of Tamil Tiger Eaelm এর নেতা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণ রাষ্ট্রপতি কুমারাতুঙ্গার কাছে একটি চিঠি লিখে শান্তিচুক্তি বাতিলের দাবি উত্থাপন করেন এবং তৎক্ষণাৎ ত্রিকোমালি পোতাশ্রয়ে দুটি গানবোটে মাইন আক্রমণ করে গেরিলারা ১২ জন নৌসেনাকে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালের ২১
এপ্রিল দুটি সামরিক ঘাঁটিতে গেরিলারা আক্রমণ চালিয়ে ৫০ জন সৈন্যকে হত্যা করে। ফলে দেখা যায় যে, তামিল সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া সফলতার মুখ দেখে নি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গনে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার অসামান্য অবদান রয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন এবং বর্তমান পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। তিনি একজন উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এককথায় তিনি যোগ্য পিতামাতার যোগ্য সন্তান । সফলতা ও ব্যর্থতা সবার জীবনেই থাকে। তারপরেও আমরা বলতে পারি যে, তিনি একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে তাঁর নাম বিশ্বের বুকে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।