Answer

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য সাধনার ইতিহাস আলোচনা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যধর্মী চিন্তাধারা পর্যালোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যধর্মী চিন্তাধারা বর্ণনা কর।
উত্তর৷। ভূমিকা :
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবতার জয়গান গেয়ে যে দার্শনিকের আবির্ভাব হয় এবং যাঁকে বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতো ঐ অর্থে দর্শনালোচনা না করলেও সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর যে মত প্রকাশ হয়েছে তা প্রকৃত অর্থে দর্শনের মর্যাদা অবশ্যই পেতে পারে। কারণ অন্ধ আবেগের পরিবর্তে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সঙ্গ সাহিত্যে স্থান নিয়েছেন। এছাড়াও তাঁর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল যা তাঁকে একজন পরিপূর্ণ দার্শনিক হয়ে উঠায় বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য সাধনা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্য সাধনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাত্র খোলো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হয়। নিম্নে তাঁর কাব্য সাধনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো :
১. সাধক কবি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র সংগীতের মাধ্যমে, সাহিত্যের মাধ্যমে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে কাব্যচর্চার প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তাই অতি অল্প সময়ে তিনি বিভিন্ন কাব্য রচনা করে কাব্যের প্রতি তাঁর যে অসাধারণ আকর্ষণ তা তুলে ধরেন।
২. গীতবিতান : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সংগীত অনুরাগী। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে তিনি খুব ছোটবেলা হতেই সংগীতের প্রতি দুর্বল ছিলেন। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি বহু সংগীত রচনা করে সংগীতের প্রতি তাঁর যে অকুন্ঠ প্রেম তার পরিচয় দেন। তাঁর ‘গীতবিতান’ কাব্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
৩. ছোটগল্পকার : রবীন্দ্রনাথ সার্থক ছোটগল্পের জনক। তিনি জীবনে বহু ছোটগল্প রচনা করেন এবং এসব ছোটগল্পে তিনি সমাজ, দেশ, জাতির বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তুলছেন। তিনি এসব ছোটগল্পের মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দিতেন। কাজেই তাঁর কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে তাঁর ছোটগল্পগুলো গুরুত্বের দাবিদার।
৪. জীবনের বাস্তব চিত্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যে মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষায় ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি মানুষের সুখ-দুঃখ, যন্ত্রণা, হাসি-কান্না প্রভৃতি বিষয় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করতেন।
৫. কবিতায় মানুষের জয়গান : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র ছোটগল্প রচনায় নয়, কবিতার মাধ্যমেও তিনি সাধারণ মানুষের জীবনকর্ম ফুটিয়ে তুলতেন। পৃথিবীর সকল প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষই যে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী, মানুষই যে একমাত্র প্রাণী যে পৃথিবীর সকল কর্মের মূলে কাজ করে তা লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা সবখানে নিজের কাব্য সাধনার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতেন।
৬. মানুষের সমন্বয় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের সকল দ্বন্দ্ব ভুলে সকল মানুষকে একই পতাকাতলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “একটি বাতি যেমন রাতের সকল অন্ধকার দূর করতে পারে না, তেমনি একজন ভালো মানুষের পক্ষে সমগ্র বিশ্বকে সুন্দর করা সম্ভব নয়।” তাঁর মতে, পৃথিবীর সকল মানুষ যদি সকল বিভেদ ভুলে একযোগে কাজ করে তবে সমাজের, দেশের, জাতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। এসবই তিনি তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।
৭. মানবতার জয়গান : বিশ্বকবি তাঁর কাব্য সাধনায় মানবতার জয়গান রেছেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গল্পের মাধ্যমে মানবজাতির গুণকীর্তন করেছেন। তিনি সকল মানুষকে সবার সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর দর্শন মানবতাবাদী দর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
৮. সাহিত্য বিচার : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। তিনি বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞান অর্জন করে তা কাব্য সাধনায় প্রয়োগ করেন। ফলে তাঁর কাব্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির কথা, মানুষের কথা। বাংলা সাহিত্যের যেসব গ্রন্থ রয়েছে, সেসবের ভালো মন্দের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
৯. নারীবাদী চিন্তা : বিশ্বকবি তাঁর কাব্যে নারী জাতির বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীর উপর তিনি লিখেছেন গল্প, কবিতা, গান ইত্যাদি। কাজেই নারী তাঁর কাব্য সাধনায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী।
১০. মানুষের মুক্তি : রবীন্দ্রনাথের মতে, একক মনুষ্যত্বের মধ্যে মুক্তি নেই। মুক্তি নিহিত সমগ্র মানবসমাজের পূর্ণ বিকাশে। একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায় সমগ্র মানবসমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সকল মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। তিনি তাঁর কাব্য সাধনার মাধ্যমে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
১১. দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা : রবীন্দ্রনাথ সবসময় দুঃখী মানুষের পাশে ছিলেন। তিনি মানুষের দুঃখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি ভূমিহীনদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে তাঁর বিখ্যাত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় বলেছেন—
“এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।
১২. কাব্য সাধনার বিভিন্নমুখিতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে গল্প, কবিতা, নাটক, সংগীত, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। সাহিত্যের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই,যেখানে তাঁর পদচারণা নেই। তিনি তাঁর যুক্তি, মতামত প্রভৃতি বিষয় তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। এসব বিষয়ই তাঁকে বাংলাদেশ দর্শনে অবিস্মরণীয় করে তোলে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কাব্য সাধনায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অতুলনীয় অবদান। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভা পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!