“যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে” বাউলবাদের এ উক্তিটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বাউল দর্শনের দেহতত্ত্ব বা ভাও ব্রহ্মাণ্ডবাদ বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের দেহতত্ত্ব বা ভাও ব্রহ্মাণ্ডবাদ সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, বাউল দর্শনের দেহতত্ত্ব সম্পর্কিত দর্শন চিন্তা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দার্শনিকদের ভাণ্ড-ব্রহ্মাওবাদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাঙালির নিজস্ব মনন বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে বাংলার নিজস্ব আবহে বিকশিত একটি সাধনকেন্দ্রিক মরমি আদর্শিক চিন্তাধারা হচ্ছে বাউলবাদ। তাইতো ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেন, বাউল মতো বাংলার ধর্ম বাঙালির ধর্মী একান্তভাবে বাঙালির মানস ফসল বাউলরা বাংলার লোকজ সম্প্রদায়, বাউলদের সমগ্র চিন্তাধারা সাধন ক্রিয়ার মূল কেন্দ্রভূমি বা উৎস হচ্ছে দেহ। দেহের সাধনাই হচ্ছে বাউল সাধনা, বাউলদের এ দেহের সাধনা জ্ঞান, কর্ম, ভাবভক্তি ও প্রেমের উপর প্রতিষ্ঠিত আত্মতত্ত্ব জানার সাধনা যা ক্রমশ দেহ হতে দেহাতীত আধ্যাত্মতত্ত্বের সহজ
জ্ঞানলাভে অগ্রসর হয়। বাউলরা মনে করেন যে মানবদেহের মধ্যেই পরমাত্মা, মনের মানুষ বা আলেখ সাঁয়ের বাস। দেহেই সকল তত্ত্বের স্থিতি। এমনকি বিশ্বের যাবতীয় কিছুর অধিষ্ঠান এ দেহের মধ্যে তাই দেহ সম্পর্কে বাউলদের মূল উক্তি ‘যাহা নাই ভাঙে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে।’
বাউল দেহতত্ত্ব বা ভাণ্ড-ব্রহ্মাওবাদ/যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে : দেহতত্ত্ব বাউল ধর্ম, দর্শন ও সাধনার মূলভিত্তি, দেহের সাধনাই বাউল সাধনা। বাউলদের সকল প্রকার সাধন তত্ত্বের অধিষ্ঠান দেহে। বাউল মতে, পঞ্চেন্দ্রিয়যুক্ত দেহ সকল শক্তির আধার এবং আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র অবলম্বন। দেহের তুষ্টিতেই সকল সাধনার তুষ্টি।বাউলদের কাছে মানবজীবন ও মানবদেহে পরম সম্পদ। বাউলদের মতে, এ মানব দেহ ও মানবজীবন অতি অমূল্য বস্তু, কারণ মানুষ পরমতত্ত্বের প্রতিনিধি, মানুষের মধ্যেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ও পরম তত্ত্ব প্রতিবিম্বিত হয়, মানুষের মধ্যেই সোনার মানুষ, মানুষ রতন, মনের মানুষ নূরনবী ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া যায়। তাই দেহের সাধনার মাধ্যমেই তাঁরা মনের মানুষের সন্ধান করেন।বাউলদের মতে, মানবদেহ হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড, একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। দেহের অভ্যন্তরেই সকল তত্ত্ব বস্তু বা জিনিসের অধিষ্ঠান। তাই দেহ সম্পর্কে বাউলদের মূল বক্তব্য হলো- যাহা নাই ভাঙে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে অর্থাৎ মানবদেহ বা ভাণ্ডের বাইরে আর কিছুই নেই। বাউলরা দেহের মধ্যে বিশ্বের মূল উৎসের সন্ধান পান। এ দেহের মধ্যেই মূলতত্ত্ব।
আত্মা, পরমাত্মা, পরমগুরু ও পরম তত্ত্বের বাস, দেহে যেমন- পরম তত্ত্বের বাস তেমনি এ মানবদেহের মধ্যেই মাঢ়ি,তেজ, জল, বায়ু, ব্যোম, সপ্ত পাতাল, সপ্ত ঊর্ধ্বলোক, সপ্তদ্বীপ, সপ্তসাগর, সপ্ত পর্বত ইত্যাদি আছে, বাউলদের বিশ্বাস,মানব দেহে যেমন চৌদ্দ ডুবন, সপ্তদ্বীপ সমন্বিত সরোবর, দরিয়া নদ-নদী, সিন্ধু, সমুদ্র কারণবারি, অমৃতসর, চাঁদ চকোয়া,পাহাড় পর্বত, গ্রহ নক্ষত্র কাল, তিথি, কাশি, বৃন্দাবন, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি তীর্থ স্থান আছে তেমনি এ শরীরে শুক্র শনি,রজঃ বীর্য, রস রতি। দিবাকর নিশাকর, কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষ, অমাবস্যা পূর্ণিমা প্রভৃতি বর্তমান। হিন্দু বাউলের মতে, আকাশ,বায়ু অগ্নি, জল, পৃথিবী এ পঞ্চভূত, আর মুসলমান বাউল মতে, আব, আতস, খাক ও বাত এ চতুর্ভুজ ছয় বা দশ লতিফা,আঠারো চিজ, মোকাম, মঞ্জিল ইত্যাদি মানবদেহে আছে। এক্ষেত্রে বাউলরা পাঁচে পাঁচে পঁচিশ তত্ত্বের কথা বলে। এর অর্থ ব্রহ্মাণ্ডে যেমন পঞ্চভূত আছে, তেমনি দেহের মধ্যেও পঞ্চভূত আছে ও এক এক ভূতের পাঁচ পাঁচটি করে সর্বমোট পঁচিশ তত্ত্ব আছে। তীর্থ, ধর্ম, বারব্রত, পূজা, তপ, জপ ইত্যাদি সবই এদেহে মিলে মোটকথা এ দৃশ্যমান পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সমস্তই এদেহে আছে অর্থাৎ মানব দেহ একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব, তাইতো লালন বলেন, যে লীলে ব্রহ্মাণ্ডের পর সেই লীলে ভাঙ মাঝার। তাই বাউলের এ উক্তি যা নাই ভাঙে তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে। দেহের সধানাই বাউলের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা, বাউলদের সকল সাধনা ও সাধন তত্ত্বের অধিষ্ঠান দেহতত্ত্বে। মনের মানুষ তত্ত্ব, চারচন্দ্রভেদ তত্ত্ব, রূপ-স্বরূপতত্ত্ব। পরম তত্ত্ব ইত্যাদি সকল বাউল সাধনাই দেহতত্ত্ব আশ্রিত। মানবদেহের মধ্যেই আছে মনের মানুষ আলেক সাঁই। এ মনের মানুষের সাধনাই হচ্ছে বাউল সাধনা। বাউল সাধক স্রষ্টা বা আল্লাহকে বাইরে খুঁজে পান না। তিনি নিজের মধ্যে তথা মানবদেহের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করেন। যে সত্তা বাইরের শব্দে, গছে, বর্ণে এবং অসংখ্য ছন্দ ভঙ্গিতে ইন্দ্রিয় গ্রামকে অধিকার করে আছে সেই সত্তাই অন্তরে ইন্দ্রিয়াতীতরূপে কেবল মানসবৃত্তে পরম বিস্ময়ে স্ফুটিত। এ পরম সুন্দর বাউলের অন্তরে সৃষ্টি করে ভাবের উন্মাদনা, তাকে করে ভাবের উন্মাদ, প্রেমে পাগল, বাউল আপনাকে হারিয়ে ফেলে সবকিছু একাকার হয়ে যায়। বাউলের দেহভিত্তিক সাধনায় এ স্রষ্টার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার মরমি সুর বেজে উঠে। এ সুরই বিধৃত হয়েছে লালনের গানে যেখানে লালন বলেছেন,
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম তার পায়,”
এ খাঁচা মানবদেহ, পাখি রূহ বা আত্মা। আবার তিনি বলেন, ‘হায় চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখি, ভেদ পরিচয় দেয় না সে। আমার ঐ খেদে ঝড়ে আঁখি।” এ পাখি আত্মা দেহের খাঁচায় জীবনব্যাপী আত্মা নামক পাখি পোষার পরও তার পরিচয় সহজে জানা যায় না। এ দুঃখে লালনের আঁখিতে অশ্রু ঝরে। আবার এই আত্মারূপী পরমাত্মাকে পাওয়ার জন্যই বাউল চারচন্দ্রভেদ অনুশীলন করে, সহজ সাধনা করে, রূপের মধ্যে স্বরূপের অনুসন্ধান করে। ধ্যানে মগ্ন হয়। প্রেমে উন্মাদ হয়। বাউলদের দেহ সাধনা রস রতি বা রজঃ বীজের সাধনা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা মানবাত্মার স্বরূপ
উপলব্ধির সাধনা, অচিন মানুষ, রসের মানুষ, বীজরূপী পরমাত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনা আর এ অচিন মানুষ আর কেউ না, তিনি আত্মারূপী পরমাত্মা। বাউল মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। তাই দেহাবারস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত এ কারণেই বাউলের সকল সাধনা সকল ক্রিয়া দেহের তরে নিবেদিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার সার সংক্ষেপে বলা যায়, দেহই বাউলের নিকট সর্বোৎকৃষ্ট পবিত্র সত্তা, অমূল্য সম্পদ, দেহই সকল সাধনা, সকল তত্ত্বের ভিত্তি। দেহ বিনা বাউলের আর কিছুই নেই দেহই সব। দেহের মধ্যেই পরম পরমাত্মা বা ঈশ্বরের বাস। দেহের মধ্যে খুঁজলেই সব পাওয়া যায়। তাইতো বাউল বলেন,
“উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব-সার
তীর্থ-ব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সব মিলে।”

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*