মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

অথবা, “যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক”- উক্তিটির আলোকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নামকরণ কতটুকু সার্থক আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অবিস্মরণীয় নাম। জীবনের সমগ্রতাকে বোঝার এবং হাসিকান্নার অন্তরালে চৈতন্যের গভীরতাকে উপলব্ধি করার আত্যন্তিক প্রয়াস তাঁর শিল্পলক্ষ্যের মূল সংকেত। ভাবাবেগের বদলে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসে অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তিনি সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। তাঁর গল্পে মানুষের আত্মিক অন্ধকার ও জটিলতা অত্যন্ত ব্যঞ্জনাধর্মী ও বলিষ্ঠ বক্তব্যে উদ্ঘাটিত হয়েছে। মানুষের আদিম কামনার রূপ ও অস্তিত্বের সংকট কতখানি জটিল ও ভয়াবহ হতে পারে তার প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য ‘প্রাগৈতিহাসিক’
গল্পে। আমরা গল্পটির নামকরণের যথার্থতা বিশ্লেষণ করে বক্তব্যটি যাচাই করে দেখতে পারি।
নামকরণ : সাহিত্যের নামকরণ একটি শিল্প। বিখ্যাত লেখক Cavendis বলেছেন, “A beautiful name is betuer than a lot of wealth.” অর্থাৎ, ‘এক গাদা সম্পত্তির চেয়ে একটি সুন্দর নাম অনেক বেশি ভালো।’ সাহিত্য হচ্ছে মানুষের মনের আয়না। এই আয়নায় মানুষের অভ্যন্তরীণ ছায়াচিত্র ভেসে ওঠে। সাহিত্য কেবল সৃষ্টি করলেই তা সার্থক হয় না। সাহিত্যকে পাঠকের সাথে পরিচিত করে তোলার জন্য, এক রচনাকে অন্য রচনা থেকে পৃথক করে চেনার জন্য একটি শিরোনাম একান্ত আবশ্যক। এ শিরোনামই সাহিত্যের নামকরণ। শিরোনাম কোন রচনার কেবল পরিচিতিই নয়, এটি তার বিজ্ঞাপনও বটে। তাই দায়সারা গোছের একটি নামকরণ করলেই রচনার উৎকৃষ্টতা প্রাপ্তি ঘটে না। নামটি হতে হবে সহজ, সুন্দর ও অর্থবহ, যার সাথে বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য থাকবে। সুতরাং সাহিত্য যেমন একটি শিল্প, নামকরণও তেমনি শিল্পের উপকরণ।
নামকরণের ভিত্তি : পূর্বেই বলা হয়েছে, সাহিত্যের নামকরণ হতে হবে সহজ, সুন্দর ও অর্থবহ, যার সাথে রচনার বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য থাকবে। গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে নামকরণের ভিত্তি মূলত চারটি। যথা ।
১. গল্পের চরিত্র।
২. গল্পের মূল উপজীব্য।
৩. গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
৪. গল্পের ঘটনাস্থল ও পারিপার্শ্বিকতা।
গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে গল্পকারেরা সাধারণত এ চারটির যে কোন একটিকে ভিত্তি করে থাকেন।
প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নামকরণের ভিত্তি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নামকরণ করেছেন গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে ভিত্তি করে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ শব্দটির অর্থ হলো (প্রাক + ইতিহাস + ফিক = ইতিহাসের পূর্বেকার ঘটনা। এ গল্পে যে কাহিনি বা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা ইতিহাসের পূর্বেকার ঘটনা নয়। কিন্তু ঘটনা বা কাহিনির প্রাগৈতিহাসিক) মূলে যে আদিমতা ও বন্যতা তা বর্তমান সভ্যজগতের নয়- তা প্রাগৈতিহাসিক যুগের। প্রাগৈতিহাসিক যুগে অসভ্য ও অসংস্কৃত সমাজে যে মানসিকতা বিদ্যমান ছিল, আলোচ্য গল্পের চরিত্রসমূহে সেই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। গল্পের অন্তর্নিহিত সেই তাৎপর্যকে তুলে ধরেই গল্পটির নামকরণ করা হয়েছে।
গল্পের বিষয়বস্তু : ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের মুখ্য চরিত্র ভিখুকে আশ্রয় করে পাঁচী, বসির ও পেহ্লাদ চরিত্র বিকশিত হয়েছে। এদের চরিত্রে যে আদিম বন্যতা ফুটে উঠেছে তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গল্পের কাহিনি। এরা সকলেই এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার যুগের মানুষ। ভিখু আদিম হিংস্রতার এক নগ্ন প্রতিনিধি। ডাকাতি তার পেশা। নারী দেহের প্রতি তার অপরিসীম লোভ। মানুষ খুন করতে ও নারী অপহরণের ব্যাপারে সে কোন বাছ বিচার করে না। এ সকল কাজ তার কাছে যেমনি সাধারণ তেমনি উপাদেয়। আদিম প্রবৃত্তি তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তার চরিত্রে নৈতিকতার কোন স্থান নেই। তার এ নীতিহীনতা মানবসমাজকে কলুষিত ও কলঙ্কিত করে চলেছে। পৃথিবী আজ সভ্যতার আলোয় ঝলমল করলেও নীতিহীন মানুষেরা বসে নেই। ভিখুর সমগোত্রীয় এসকল অন্ধকারের কীটেরা সমাজকে দংশন করে চলেছে। পৃথিবী এখনো এদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি, কবে হতে পারবে তাও কেউ জানে না।
প্রাগৈতিহাসিক নামকরণের যৌক্তিকতা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এ গল্পটির নাম অন্যকিছুও রাখতে পারতেন। মা-বাবা তাঁদের ঔরসজাত সন্তানের নাম রাখেন যেমন মমতা মিশ্রিত করে সাহিত্যিকও তাঁর সৃষ্টির নামকরণ করেন শিল্পসম্মতভাবে। ভিখু চরিত্রে যে প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটেছে সেই অন্তর্নিহিত ভাবসম্পদকে শিল্পসম্মত করে তিনি ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামটি নির্বাচন করেছেন। এ গল্পের ভিথু, পাঁচী, বসির, পেহ্লাদ প্রমুখ সকলেই প্রাগৈতিহাসিক স্তরের মানুষ। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনাও প্রাগৈতিহাসিক যুগের। বিশেষ করে ভিখু ও পাঁচী যে জীবনের গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল এবং যে জীবনের ক্লেদাক্ত অধ্যায়কে সামনে রেখে তারা এগিয়ে গেল সে সম্পর্কে গল্পকারের মন্তব্য লক্ষ করলেই বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে যায়। গল্পকার বলেছেন, “হয়ত ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক। পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনদিন পাইবেও না।” সুতরাং, ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামকরণ যুক্তিসংগত।
নামকরণের সার্থকতা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি আধুনিক সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও আদিম, অসভ্য জীবনের নগ্নতাকেই গল্পকার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এ নগ্নতা আধুনিক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান। সুপ্ত অবস্থায় তা মনুষ্য চরিত্রের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত থাকে। অনুকূল পরিবেশ পেলেই তা আত্মপ্রকাশ করে। ভিখু, বসির ও পাঁচীর দেহমনে যে প্রাগৈতিহাসিকতা বিদ্যমান তা তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নয়, তা সমগ্র মানবসমাজের অন্ধকার জীবনের
বৈশিষ্ট্য। এ প্রাগৈতিহাসিক বৈশিষ্ট্য মানুষকে ডাকাত, খুনী ও ধর্ষকে পরিণত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কাহিনি চরিত্র ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিচার করে দেখা যায়, গল্পটির সর্বত্র প্রাগৈতিহাসিক মনমানসিকতা ও রুচির পরিচর্যা করা হয়েছে। সুতরাং অন্য যে কোন নামের চেয়ে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামটিই এই গল্পের জন্য অধিকতর যুক্তিসংগত ও শিল্পসম্মত হয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%88%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*