মনিপুরী উপজাতির জীবনধারা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
অথবা, উপজাতির সংজ্ঞা দাও। মনিপুরী উপজাতির জীবনবিধান আলোচনা কর।
অথবা, মণিপুরী উপজাতিদের জীবন প্রণালি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বর্তমানে আধুনিক সভ্য সমাজে যারা বন ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে আসছে তাদেরকে বুঝাতে আদিম, আদিবাসী, উপজাতি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। বর্তমানের সভ্য সমাজের সাথে এদের সম্পূর্ণ যোগসাজশ না থাকলেও সভ্যতার ছোঁয়া যে একেবারে পায়নি একথা বলা যায় না। কিছু কিছু উপজাতি আধুনিক
শিক্ষাগ্রহণ করছে, সভ্যতার সংস্পর্শে আসছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ উপজাতি পাহাড় এবং বনাঞ্চলে বসবাস করে। উপজাতিদের জীবনচরিত্র কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
মনিপুরী উপজাতির জীবনধারা : বাংলাদেশে মনিপুরী উপজাতির বসবাস হাজার বছর ধরে। তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নামকরণ : মনিপুরী সমাজে একটি শ্লোক পরিচিত আছে। শোকটি এরকম, “মনি নাং পরিবৃত পুরঃ ইতি মনিপুর।” এ শ্লোকটির মাধ্যমে জানা যায় মনিপুরীরা মনিপুর রাজ্যের অধিবাসী। ভারতের মনিপুর রাজ্যের সাথে পার্শ্ববর্তী আসামের কয়েকবার যুদ্ধ বাঁধে। পরবর্তীতে ইংরেজদের আগমনে মনিপুর রাজ্যের মনিপুরীরা ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। মনিপুর রাজ্য থেকেই তাদের নামকরণ করা হয়েছে মনিপুরী।
২. বসবাসের স্থান : এ.কে. শেরাম তার ‘বাংলাদেশের মনিপুরী’ গ্রন্থে মনিপুরীদের বসবাসের স্থান বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে মনিপুরীদের বাস মূলত বৃহত্তর সিলেট জেলায়। তবে জানা যায় যে, এক সময় ঢাকার তেজগাঁও এলাকার মনিপুরী পাড়া, ময়মনসিংহের দুর্গাপুরের কোনো কোনো স্থানে এবং বৃহত্তর কুমিল্লার কসবা এলাকায়ও এদের বসবাস ছিল। কিন্তু কালক্রমে ধীরে ধীরে এসব এলাকায় মনিপুরীদের বিলুপ্তি ঘটেছে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে এদের বসতি রয়েছে। যেমন-
৩. দেহের আকৃতি : মনিপুরীরা মাঝারি আকৃতির। তাদের দৈহিক গড়ন বেশ মজবুত। গায়ের রং ফর্সা, শ্যামলা ও কালো। তাদের কোমর একটু চিকন।
৪. ভাষা ও বর্ণমালা : মনিপুরীদের গোত্রভেদে ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। যথা : ক. বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা ও খ. মৈতৈ ভাষা।মনিপুরীদের নিজস্ব ভাষা ছাড়াও বর্ণমালা ও সাহিত্য আছে।
৫. পোশাক পরিচ্ছদ : মনিপুরীরা নিজেদের তৈরি পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে। পুরুষেরা ধুতি, পাঞ্জাবি পরে। মহিলারা শাড়ি, ব্লাউজ, লাহিং পরে। তারা আধুনিক বিভিন্ন পোশাকও পরিধান করে। এগুলোর মধ্যে প্যান্ট, শার্ট, কোট, মহিলারা সালোয়ার, কামিজ প্রভৃতি পরে। মেয়েরা প্রসাধন সামগ্রীর প্রতি খুবই আকৃষ্ট।
৬. খাদ্যদ্রব্য : মনিপুরীরা প্রধানত ভাত, মাছ, শাকসবজি খায়। মাংস ভক্ষণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা এটি গ্রহণ করে না। কচি বাঁশের নরম অংশ দিয়ে তারা সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করে। মাংস ছাড়া বাজারে প্রাপ্ত সব ধরনের খাদ্য তারা খায় । শুঁটকি দিয়ে তরকারি খেতে তারা অভ্যস্ত। কলাগাছের থোড় দিয়েও তারা সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করে।
৭. ধর্ম : মনিপুরীদের ধর্মীয় বিশ্বাসে হিন্দুধর্মের স্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। তারা প্রতিদিন তিনবার পূজা অর্চনা করে। গ্রামের মন্দিরে তারা এ পূজা দিয়ে থাকে। তারা রাধাকৃষ্ণ, শিব, বিষ্ণুর পূজা করে। তারা অনেক প্রাকৃতিক শক্তিকেও পূজা দেয়।
৮. সামাজিক উৎসব : মনিপুরীরা ১ বৈশাখ দোল পূর্ণিমা, পৌষ সংক্রান্তি প্রভৃতি উৎসবের আয়োজন করে। এছাড়াও তারা কার্তিক মাসে রাস উৎসব পালন করে। এটি তাদের সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব। প্রতিটি ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবে নৃত্যগীতের আয়োজন করা হয়। পৌষ মাসে যুবক-যুবতীরা ‘গুণসিনা’ উৎসব পালন করে।
৯. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : মনিপুরীরা কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবননির্বাহ করে। কৃষি তাদের আয়ের প্রধান উৎস। কৃষিকাজে নারী পুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করে। মনিপুরী মহিলারা অনেক পরিশ্রম করতে পারে। মনিপুরীরা কৃষি ছাড়াও নানামুখী পেশার সাথে যুক্ত। তারা নিজস্ব তাঁতে পোশাক তৈরি করে বিক্রি করে। তাদের অনেকে স্বর্ণকার, কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিকের কাজ, কলকারখানার কাজ, দর্জির কাজ প্রভৃতি করে থাকে। আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে তারা ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষকতা প্রভৃতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।
১০. বিবাহ : মনিপুরী সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে কতকগুলো বিধিনিষেধ ও নিয়মনীতি পালন করা হয়। একই গোত্রের ছেলেমেয়ের সাথে বিয়ে হতে পারে না। তাদের সমাজে ঘরজামাই থাকার প্রচলন আছে। বিবাহে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ।
১১. বিবাহবিচ্ছেদ : মনিপুরী সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা খুবই কম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ লেগে থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হয়। গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানা হয়। দোষী পক্ষকে জরিমানাস্বরূপ বিভিন্ন জিনিস অপরপক্ষকে দিতে হয়।
১২. সাহিত্য চর্চা : মনিপুরী সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ। তাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের নাটক, গল্প, উপন্যাস, কাব্য, লোকগাঁথা, লোককাহিনী, লোকগীতি, লোকসাহিত্যের প্রচলন আছে। ভারতে মনিপুরী সাহিত্য চর্চা বেশি হলেও আমাদের দেশে সে তুলনায় অনেক কম। ১৯৭৫ সালে তারা সাহিত্য পত্রিকা ‘দীপান্বিতা’র মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা শুরু করে। তারা ‘বসন্ত কুন্নি পাগলী নৌরাং’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ করেছে।
১৩. বাড়িঘরের ধরন : মনিপুরীরা বাঁশ ও ছনের তৈরি বাড়িঘর নির্মাণ করে। তারা বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন ফল ও বনজ গাছ লাগায় । অবস্থাসম্পন্ন মনিপুরীরা পাকা বাড়িঘর নির্মাণ করে।
১৪. মৃতের সৎকার : মনিপুরী সমাজে মৃতদেহ দাহ করা হয়। মৃত ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে এনে উত্তরমুখী করে সাজানো হয় এবং পরে গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়। নতুন কাপড় পরিধান করিয়ে শ্মশানে নেওয়া হয়। সাতটি গোত্রের চিহ্নস্বরূপ সাতস্তর কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো হয়। দাহশেষে শ্মশান থেকে ফেরার পথে সবাই গোসল করে। মৃত্যুর
১৩ দিন পর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
১৫. মনিপুরী সংস্কৃতি : মনিপুরীদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা বেশ উন্নত। নাচ ও গানের মাধ্যমে তারা তাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তাদের নৃত্য ও গান ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেই উদ্ভব হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতেও তাদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা সব ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে এ নৃত্য গীতের
আয়োজন করে। তাদের নৃত্য দু’টি ধারায় বিভক্ত; যথা : লোকনৃত্য ও ধ্রুপদী নৃত্য। লোকনৃত্যের মধ্যে লৈশেম জাগোই, মাইবী জাগোই, লৈমা জাগোই প্রভৃতি। ধ্রুপদী নৃত্যের মধ্যে রাস নৃত্য, মৃদঙ্গ নৃত্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য তারা বিভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে। নৃত্যের সাথে সাথে তারা সঙ্গীত পরিবেশন করে এবং বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটের একটি মনিপুরী গ্রামে মনিপুরী নৃত্য উপভোগ করেন । তিনি এতে মুগ্ধ হয়ে এ নৃত্যের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মনিপুরী উপজাতি যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এ দেশে বসবাস করে আসছে। প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তারা জীবন অতিবাহিত করেছে। কোনো কোনো উপজাতীয় সমাজ তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। আধুনিকতার স্পর্শে তাদের অনেকে সভ্য সমাজের সাথে খাপখাইয়ে চলতে শুরু করেছে। অনেক উপজাতির জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে দূর করে অস্তিত্বের সংগ্রামে তাদের লড়াকু ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। উপজাতিরা আমাদের সমাজেরই অংশ। সার্বিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে উপজাতিদের উন্নতিকল্পে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।