বৌদ্ধদর্শনের প্রভাবশালী ধারা কয়টি ও কী কী? বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বৌদ্ধদর্শন কিভাবে বাঙালি দর্শনকে প্রভাবিত করেছে? আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী প্রভাবশালী বৌদ্ধ ধারা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন কি বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত? এ সম্পর্কে তোমার অভিমত দাও।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
প্রাচীনকালে বাঙালি দর্শনের বিকাশে যেসব বেদ বিরোধী চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায় বৌদ্ধদর্শন তার মধ্যে অন্যতম।যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু পূর্বে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে; বুদ্ধের কতিপয় শিষ্য বাংলায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের মাধ্যমে এর সূচনা করেন। বাঙালি দার্শনিকগণ বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙালি দার্শনিক চিন্তাধারায় বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব অপরিসীম।

বৌদ্ধদর্শনের প্রভাবশালী ধারা : বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর তাঁর শিক্ষা ও বাণী নিয়ে ভিক্ষু বা শিষ্যদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মিলন সভা বলে খ্যাত বৌদ্ধ দ্বিতীয় সংগীতিতে এ বিভক্তির সূচনা হয়। ফলে দুটি সম্প্রদায় বা ধারার উদ্ভব ঘটে। যথা :
ক. থেরবাদী ও
খ. মহাসাংঘিক।
এ দুটি ধারা থেকে আরো বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো :
ক. হীনযান সম্প্রদায় ও
খ. মহাযান সম্প্রদায়।
ক. হীনযান সম্প্রদায় : হীনযান কথাটির অর্থ হলো ক্ষুদ্রযান। এরা কর্মবাদে বিশ্বাস করে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা কামনা বাসনাকে জয় করার মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায় বলে মনে করেন। একজন হীনযানী নিজের নির্বাণ বা মুক্তি লাভের জন্য চেষ্টা করবে এবং এজন্য পরিবার ও সমাজ পরিত্যাগ করে কৃচ্ছতা ব্রত পালন করবে। তাদেরকে অরহৎ নামেও অভিহিত করা হয়। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এদের মতবাদ সর্বাস্তিবাদ বলে পরিচিত। অন্যের মুক্তির কথা চিন্তা করা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বিষয়। হীনযান সম্প্রদায়ে ধর্মগ্রন্থ হলো পবিত্র ত্রিপিটক।
খ. মহাযান সম্প্রদায় : মহাযান বলতে উচ্চ মার্গকে বুঝায়। গৌতম বুদ্ধ এ সম্প্রদায়ের মূল নির্দেশনা দান করেছেন। হীনযান অপেক্ষা এ ধারা অধিক নমনীয়, উদার ও মানবতাবাদী। এরা কোনো প্রকার কৃচ্ছসাধনের পক্ষে নয়। এবং নিজের ও অন্যের কল্যাণ লাভের জন্য মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করার কথা বলে। আর তাই এদের মহাযানী বা মহাযান সম্প্রদায় নামে অভিহিত করা হয়। বৌদ্ধদের অন্যতম দুটি সম্প্রদায় মাধ্যমিক ও যোগাচার সম্প্রদায় মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। মহাযান সম্প্রদায়ের মূল ধর্মগ্রন্থ “মহাযান সূত্র” নামে পরিচিত।
বাঙালি দর্শনের উপর বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব : প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় বৌদ্ধ মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসবাস লক্ষণীয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলে এরা সর্বাধিক বসবাস করছে। বাঙালি চিন্তাচেতনার সাথে তাদের মতবাদ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে বর্তমান দার্শনিক আলোচনায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রাচীন বাঙালি সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহার, সংঘ, মঠ, মহাবিহার প্রভৃতি ধর্ম ও দর্শন চর্চার প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত হতো। বাঙালি চিন্তা ও মননে তাদের এ প্রভাব যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বাঙালি
দর্শনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. শীলভদ্রের দর্শনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব : প্রাচীন বাঙালি দর্শনের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক শীলভদ্র বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দর্শন চর্চা করেন। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র, মহাযান দর্শন, বেদ, হেতুবিদ্যা, শশাকবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা ও সাংখ্য দর্শনে তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো বৌদ্ধ মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদ। প্রাচীন বাংলায় দর্শন, যুক্তি, প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ, মানবতাবাদ ও বিভিন্ন সূত্রের ব্যাখ্যাকার হিসেবে তাঁর অসামান্য খ্যাতি রয়েছে।
২. আচার্য চন্দ্রগোমীর দর্শনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব : তাঁর দর্শনচিন্তা বাঙালি দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর অমর কীর্তির মধ্যে রয়েছে চান্দ্রব্যাকরণ। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।তিনি ব্যাকরণ রচনার পাশাপাশি নাট্যকার,নৈয়ায়িক, বৌদ্ধতন্ত্রের লেখক, জ্যোতিষ ও আয়ুর্বেদজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তার সমস্ত চিন্তাভাবনাই বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
৩. পাল রাজাদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব : বাংলায় পাল রাজাদের শাসনামল প্রাচীন বাংলায় স্বর্ণযুগ নামে পরিচিত। এ সময়ে ধর্ম, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা সর্বাধিক পরিমাণে বিকাশ লাভ করে। পাল রাজাদের শাসনামলে বাংলায় সকল সম্প্রদায়ের জ্ঞানবিজ্ঞান তথা দর্শন চর্চার পথ সুগম হয়। অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির নির্মিত হয় যা ধর্ম ও দর্শন চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। ফলে বৌদ্ধধর্মতত্ত্ব ও দর্শন চিন্তা বাঙালি ধর্ম ও দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হয়। ফলে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে বা ভূখণ্ডেও বাঙালির মননসাধনার ফল সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম প্রভৃতি বিস্তার লাভ করে। পাল শাসনামল থেকেই বাংলায় থেরবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতবাদ প্রচারিত হয়। যার ধারাবাহিকতা বর্তমান সময়েও লক্ষ করা যায়।
৪. বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধ মহাযানী সম্প্রদায়ের প্রভাব : গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত মতবাদই মহাযানী মতবাদ। যা বাংলা ভূখণ্ডে এসে নতুন রূপে বিকশিত হয়। বাঙালি দর্শনে মহাযান সম্প্রদায়ের মতবাদ মানবতা, সৌভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণকামী রূপ পরিগ্রহ করে। ফলে একদিকে মানবতাবাদ অপরদিকে জীবনমুখিতার উন্মেষ ঘটে।
৫. বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধ তান্ত্রিক প্রভাব : কালক্রমে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনতত্ত্ব মূল ধারা থেকে সরে আসার ফলে নতুন নতুন ধারার সৃষ্টি হয় যা তন্ত্রবাদ নামে পরিচিত। গভীর তান্ত্রিকতার কারণে বৌদ্ধদর্শনে যোগাচার তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতবাদের উদ্ভব হয়। ফলে বাঙালি দর্শনে অনাত্মবাদ, কর্মবাদ, নিরীশ্বরবাদ এর স্থানে বৌদ্ধধর্মের জয় জয়কার সূচিত হয়। এ সময়ই বাঙালির ধর্মচর্চায় সাধনতত্ত্ব পূজাচারের প্রসার ঘটে। তাই সহজেই বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতবাদ প্রভাব বিস্তার করে।”
৬. বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের প্রভাব : প্রাচীন বাঙালি দর্শন চর্চায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।সিদ্ধাচার্যের কাব্য চিন্তায় দর্শন প্রতিফলিত হয়। তিনি যোগাচার ও মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের মূল দর্শন তত্ত্বকে অবলম্বন করে দোহা রচনা করেন। সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে সরহপাদ, নাগার্জুন, লুইপাদ, তিল্লোপাদ, নাড়োপাদ, শবরপাদ, অদ্বয়বজ্র, ভুসুক, কুক্কুরিপাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তারা কাব্যের মাধ্যমে বৌদ্ধদর্শনতত্ত্ব প্রকাশ করেন। যেমন-
“কায়া নাবড়ি খাস্টি মন কেডু আল।
সদগুরু বচনে ধর পতবাল।”
এখানে কায়া একটি নৌকা, খাঁটি মন বৈঠা। সদগুরুর বচনে হাল ধরা। অর্থাৎ সবই একই দেহে প্রচ্ছন্ন শক্তিরূপে বিদ্যমান নিষ্কলুষ মন মাঝি বা বৈঠা স্বরূপ এবং সদগুরুর বাক্য অর্থাৎ সত্য, নির্বাণ, মহাসুখ গুরু বাক্যের মধ্যে নিহিত।এখানে গুরু হলেন হাল স্বরূপ।
৭. বাঙালি দর্শনে বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদের প্রভাব : বৌদ্ধ সহজযানীদের চিন্তাভাবনার উপরে ভিত্তি করে সহজিয়া দর্শন প্রতিষ্ঠিত যা বাঙালি দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বৌদ্ধ সহজযানীদের একটি সম্প্রদায় রাধাকৃষ্ণের লীলাকে মৈথুন বা মিথুন তত্ত্বের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছিল। বৈষ্ণব পদাবলির ধ্যানধারণায় সহজিয়া মতবাদের প্রভাব রয়েছে। চণ্ডীদাশের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ড. বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শনের প্রভাব লক্ষণীয়। মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শনের চূড়ান্ত পরিণতি হলো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম।
৮. বাউল, বৈষ্ণব, সুফি, চৈতন্য প্রভৃতি মতবাদের উপর বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব : বাউল মতবাদে বৌদ্ধদের প্রভাব সুস্পষ্ট। সুফি দর্শনও বৌদ্ধ দর্শনের শূন্যতত্ত্ব ও দেহতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। চৈতন্যবাদের মৈত্রী ও অহিংসা তত্ত্ব এবং বৈষ্ণবীয় মূলতত্ত্ব ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ ভাবধারা বৌদ্ধ প্রভাবজাত বলে মনে হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব বৌদ্ধদর্শন দ্বারা প্রভাবিত। বৌদ্ধদের কর্মবাদ, মোক্ষ বা নির্বাণ তত্ত্ব, অনাত্মবাদ প্রভৃতি দর্শনতত্ত্ব বাঙালি দার্শনিকদের প্রাচীনকাল থেকেই প্রভাবিত করে আসছে।বাঙালির চিন্তা জগতে বা মনন ও দর্শনে বৌদ্ধদের প্রভাবেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি পণ্ডিতগণ বৌদ্ধ দর্শনকে মূল আলোচ্যবিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বাঙালি দর্শনে সমৃদ্ধি দান করেন। তাই অনেকে মনে করেন বৌদ্ধদর্শন বাঙালি দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ। বাঙালি দর্শনচিন্তার বিকাশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বাঙালি দর্শন ও বৌদ্ধদর্শন একই সূত্রে সূত্রবদ্ধ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*