বৈষ্ণব দর্শনের মানবতাবাদী আদর্শ বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, জাতি, ধর্ম, বর্ণের তথাকথিত বাছবিচার বৈষ্ণবের ছিল না” – এ উক্তির আলোকে বৈষ্ণব মানবতাবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় মানবতাবাদী দর্শন বর্ণনা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় প্ৰেমতত্ত্বে উৎসরিত মানবতাবাদ সম্পর্কে যা জানো লেখ।
অথবা, “বৈষ্ণব দর্শন মানবতাবাদী দর্শন”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম, দর্শন ও মনন সাধনার ইতিহাসে বৈষ্ণববাদ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বৈষ্ণববাদের মূল উৎস বীজ অতি প্রাচীন কালে নিহিত হলেও মধ্যযুগীয় বাংলায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের হাতেই এ মতবাদ প্রচার ও পূর্ণতা লাভ করে। মূলত শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম ও দার্শনিক মতই বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন বা এম দর্শন নামে সকলের নিকট সমধিক পরিচিত। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রেম দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ, মানুষের সার্বত্রিক কল্যাণ, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বা প্রেমের বিস্তৃতি। মূলত তিনিই বাঙালিকে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করান ‘জীবে ব্রহ্ম, নরে নারায়ণ’। অর্থাৎ মানবপ্রেম ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর ধর্ম ও দর্শন মতে। মানুষ ও মানবতাকেই এতে স্থান দেয়া হয়েছে সবার উপরে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের তথাকথিত বাছবিচারের পরিবর্তে পারস্পরিক প্রেম, সম্প্রীতি, সৌহাদ্য ও ভ্রাতৃতের বাণীতেই এ মতবাদের মানবতাবাদী আদর্শের ভিত্তিভূমি রচিত।
বৈষ্ণব মানবতাবাদ : সাধারণভাবে ‘Humanism’ বা মানবতাবাদ বলতে বুঝায় মানুষ মানবতা ও মানবিক বিষয়াদির সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিতির তরে নিবেদিত দার্শনিক মতবাদকে। অর্থাৎ মানবিক বিষয়াদির প্রতি আগ্রহ মনুষ্য কল্যাণকর নীতি জাত দার্শনিক মতবাদই মানবতাবাদ। ইউরোপে মানবতাবাদী দার্শনিক আদর্শের উদ্ভব রেনেসাঁর ফসল হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে মানবতাবাদী চিন্তার ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তাধারা চর্যাপদ বা বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমত থেকে উদ্ভূত হয়ে ক্রম বিকশিত। আর বাঙালির চিন্তায় বিকশিত এ মানবতাবাদী আদর্শেরই একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বৈষ্ণব মতে। বৈষ্ণববাদের মূল কথা প্রেম, কৃষ্ণপ্রেম হলেও তা মানব আশ্রিত। মানবতা বা মানবপ্রেমই হচ্ছে এ মতে কৃষ্ণ বা ঈশ্বর প্রেমের সোপান। বৈষ্ণব মতে, জ্ঞান নয়, কর্মে নয়, প্রেমভক্তির মাধ্যমেই কেবল সসীম মানুষের পক্ষে পরম ঐশীপ্রেমার্জন ও উপলব্ধি সম্ভব। বৈষ্ণব মতে মনে করা হয়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল মানুষ সকল জীবে বর্তমান। তাই মানুষের সেবা করা আর ঈশ্বরের সেবা করা একই কথা। মানুষকে সেবা করলেই ভাগবানকে পাওয়া যায়। বিপরীতক্রমে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভগবানের সেবা করার অর্থই হলো মানুষের সেবা করা। কারণ সকল মানুষ সকল জীবে ঈশ্বর বিরাজমান। বৈষ্ণবদের এ প্রেমভক্তি প্রসূত দর্শনে `অতীতের জ্ঞানমূলক দর্শনের সসীম ও অসীম তথা সৃষ্টি (মানুষ) ও ভগবানের (ঈশ্বর) মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান ছিল তা দূরীভূত হয়ে স্বর্গ ও ভগবানের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব হ্রাস পেল। ভগবানের অধিষ্ঠান হলো মানুষের মধ্যে। তাই বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূল কথাই হলো জাতি নয়, শ্রেণি নয়, কুল নয়, ভক্তি ও প্রেমই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়। প্রেমই হলো মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ অনাবিল
প্রেমশক্তির বলেই মানুষ মুক্ত হতে পারে পাশবিক প্রবৃত্তির বন্ধন থেকে এবং সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে সর্বজীব ও স্রষ্টার মধ্যে। আর এ মানবপ্রেমের কথাই বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনে। বাংলায় গোড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্য দেব এ মানবতাবাদেরই প্রচার করেছেন, জয়গান
গেয়েছেন। তাঁর নিকট মানবপ্রেমই ছিল সর্বাত্মক মিলনের নামান্তর। এ প্রেমের বাণীকে তিনি অনুশীলন করেছেন সারা জীবন । মধ্যযুগের এক পর্যায়ে যখন হিন্দু বাঙালিরা বর্ণভেদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মরার উপক্রম হয়েছিল, মানুষে মানুষে ভেদ হিন্দু সমাজের কাঠামোকে প্রায় দুর্বল করে দিয়েছিল, হিন্দুরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে হিন্দুসমাজের ভাঙন যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ঠিক সেসময় একজন যোগ্য কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি এমন জনগণের কাছে প্রচার করতে থাকেন যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কোনো স্থান ছিল না। তিনি মনে করতেন সকল জীবই পরমস্রষ্টা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্ট জীবকে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। হরিনাম দর্শন উপদেশ দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে ঈশ্বরাভিমুখ করে তাদের জীবনমান উন্নত করতে সচেষ্ট হলেন। সমাজ ও সংসারে যারা অত্যন্ত দুর্গত, বিনা দোষে সমাজ সংস্কৃতি বহিষ্কৃত, তারাও কৃষ্ণের জীব, তাদের দেহও কৃষ্ণের মন্দির এ বিশ্বাস ও বোধ জাগিয়ে তুলে তিনি তাদের শ্রেষ্ঠ মানুষের আসরে সমান আসনের অধিকারী করলেন। অর্থাৎ মানুষকে তিনি দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। তাই দেখা যায় ‘জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি’ ও সে ভক্তি উদ্দীপনের জন্য নাম- সংকীর্তন এর উপরই ছিল চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এ কারণেই চৈতন্যের মানবপ্রেমের উৎকর্ষতা বর্ণনা করতে গিয়ে
একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন- “পবিত্র প্রেমের সাধক যে চৈতন্য কৃষ্ণনাম করিয়া ধুলায় গড়াগড়ি দিতেন তিনি বাঙালির সম্মুখে যে গৌরবের আদর্শ তুলিয়া ধরিলেন, মধ্যযুগে তাহার তুলনা মিলে না।”
মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণভেদের ঊর্ধ্বে : বৈষ্ণব প্রেমধর্মে জাত ধর্ম বর্ণের তথাকথিত বাছবিচারের কোনো স্থান নেই। এ ধর্ম জাতির প্রতি জাতির বিদ্বেষ ও অবিচার এবং এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের বিভেদকে বর্জন করা হয় সর্বাত্তাকরণে। মানুষে মানুষে সাম্য সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ়করণ এবং পরস্পরের প্রতি প্রেম স্থাপন করাই বৈষ্ণব ধর্মদর্শনের মূলভিত্তি। তাই বৈষ্ণব সাহিত্য ও দর্শনে প্রেম, সাম্য ও মানবতাবাদের যে অমোঘ বাণী বিঘোষিত তা কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত নয় বরং নিয়োজিত মানুষে মানুষে ব্যাপক সম্প্রীতির বন্ধন রচনায়। বস্তুত তৎকালীন
বর্ণাশ্রিত, জাতিভেদ প্রথায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত বাঙালি সমাজে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে মানবতাকে রক্ষা করতেই উদ্ভূত হয়েছিল বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের। তাই শ্রীচৈতন্য দেব সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষই সমান এবং সবাইকে একই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। ব্রাহ্মণ শূদ্রের কোনো ভেদ তাঁর নিকট ছিল না বরং সকল প্রকার অভিন্নতা দূর করে এক অখণ্ড মানবজাতি গড়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। বৈষ্ণব দর্শনের এ বর্ণবিভেদ মুক্ত মানবতাবাদী দিকটিকেই তুলে ধরতে গিয়েই ড. আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, “বস্তুত সেই দিনের ব্রাহ্মণ্যবাদী
বর্ণবিভেদের পরিবেশে মানুষে মানুষে যখন রচিত হয়েছিল এক বিরাট বৈষম্য, ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো যখন প্রবেশাধিকার ছিল না সমাজে ঠিক তখনই শ্রীচৈতন্য এগিয়ে এলেন সাম্য, সৌভাত্র বিশ্বমানবতার এ অমোঘ বাণী নিয়ে :
“বৈষ্ণবের জাতিভেদ করিলে প্রসাদে।
বৈষ্ণবের জাতিভেদ নাহিক সংসারে।”
মোটকথা সকল প্রকার জাতিবর্ণভেদ তথা মানুষে মানুষে সৃষ্ট বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতি ও সার্বত্রিক মানব কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই বৈষ্ণব মানবতাবাদের মূলমন্ত্র।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার সমাপ্তিতে বলা যায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলায় আচ্ছাদিত বৈষ্ণব দর্শনের নিগূঢ় লক্ষ্যে মানবতাবাদেরই পরম বিকাশ ঘটেছে। এ দর্শনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকে সৃষ্টি ও স্রষ্টা তথা প্রকারান্তরে মানবপ্রেমের ভিতই রচিত হয়েছে সর্বান্তকরণে। মানুষে মানুষে কোনো ভেদ, জাতিতে জাতিতে কোনো বিভেদ দ্বন্দ্ব বৈষ্ণব দেখতে পায় না বরং সব মানুষের মধ্যেই সে ভগবান বা কৃষ্ণকে দেখতে পায়। তাই ভগবান সেবার নামে সে মানুষেরই সেবা করে। ভগবানকে পাওয়ার মাধ্যমে সে মানুষকেই পেতে চায়।তাইতো বৈষ্ণবের প্রেম ও মানবিক আদর্শের স্পর্শে একাকার হয়ে যায় যুগ, জাতি, দেশ, ধর্ম ও সমগ্র মানবতা।