বেঙ্গল রেনেসাঁ কী? রেনেসাঁর পটভূমি আলোচনা কর।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁয় পাশ্চাত্য প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বেঙ্গল রেনেসাঁ উনিশ শতকে বঙ্গদেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ পরিবর্তনকে বেঙ্গল রেনেসাঁ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। প্রথমত, কতিপয় ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও মিশনারি এবং স্থানীয় বিজ্ঞজনদের মধ্যে যোগাযোগ-সংশ্লেষের ফলে এ পরিবর্তন দেখা দেয়। এ রেনেসাঁর উদ্ভব কলকাতায়।
বেঙ্গল রেনেসাঁ : পনের শতকে শ্রীচৈতন্য ও তাঁর পর্ষদদের প্রয়াসে বাঙালি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে সব বিভাগে, বাঙালির জীবনে সংঘটিত হয় এক ভাবপ্লাবন। সমাজ, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি প্রভৃতি সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সূচিত হয় এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা, সংঘটিত হয় এক বিরাট আলোড়ন। এ আলোড়নই পরিচয় লাভ করে বেঙ্গল রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ নামে।
রেনেসাঁর পটভূমি : সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, ১৮৩০ সালের আগে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনাসহ ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতি ও ছোট-বড় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠা তার একটি বড় নিদর্শন। কলকাতার উচ্চশ্রেণির লোকেরা এটি গড়ে তোলেন। এটি ছিল তখন সমগ্র এশিয়ায় ইউরোপীয় আদলে উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। এ সময়ে কলকাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে সংবাদপত্র, সাময়িক পত্রিকা এবং বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। কলকাতায় একটি সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ক্রমশ বিজ্ঞজনেরা আধুনিক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন। সে সাথে নিজেদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার এবং ইউরোপীয় ঘটনাবলি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকেও মনোযোগ দেন। এভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমনেও সচেতনতা বেড়ে চলে। আধুনিকতার ইতিবাচক বিষয়গুলোর উপর যেসব ব্রিটিশ কর্মকর্তাগণ প্রভাব বিস্তার করেন, প্রধানত তাঁরা ছিলেন স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন কিছু সরকারি, সামরিক ও বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কিছু মিশনারি। ইতিহাসের পরিভাষায় এঁদের বলা হয়েছে প্রাচ্যবিদ। এঁরা অষ্টাদশ শতকের যুক্তিবাদ, ধ্রুপদীচিন্তা এবং উদার আন্তর্জাতিকতায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। হেনরি টমাস কোলব্রুক, উইলিয়ম কেরী, হোরেস হেম্যান উইলসন এবং জেমস প্রিন্সেপ ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ প্রাচ্যবিদেরা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিশ্বজনীন রাখার চেষ্টা করেন। জাতিভেদের প্রাচীর তুলে তাঁরা শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেন নি। বস্তুত, প্রাচ্যবিদেরা বাঙালি বিদ্বানদের সাথে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাঁদের কাছে নিজেদের তুলে ধরেন ইউরোপীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উৎস হিসেবে। তাঁরা দেশীয় বিদ্বানদের থে মিলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। গভর্নর জেনারেল ওয়েলসলি ১৮০০ সালে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও স্থানীয় বিষয় সম্পর্কে শিক্ষাদানের উদ্দেশে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপন করেন। কলেজটি প্রাচ্যবিদদের কর্মকাণ্ডের অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে। এ প্রতিষ্ঠান ছিল ইউরোপীয়দের গড়ে তোলা প্রথম উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র, যেখানে দেশীয় পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা
হয় এবং তাঁদেরকে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের কাজে উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষার উন্নতির লক্ষে প্রাচ্যবিদদের সমর্থন আদায় করে এ কলেজ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এবং উইলিয়ম কেরীর শ্রীরামপুর মিশনকে ভারতীয় সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। রামমোহন রায়কে (১৭৭২-১৮৩৩) বলা হয় রেনেসাঁর প্রথম বাঙালি মনীষী। রেনেসাঁ ও আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে রামমোহন ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কার দুইই করতে ব্রতী হন। তিনি পণপ্রথা, সতীদাহ এবং কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধেও মত প্রকাশ করেন। উনিশ শতকে হিন্দু কলেজের যে তরুণ ছাত্রদের নিয়ে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী গড়ে উঠে, তাঁরা ভারতের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির দিকে তাকানো নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। এ গোষ্ঠীর নেতা হেনরি ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরেজির শিক্ষক (১৮২৬-১৮৩১) ছিলেন। এ গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়েছেন সমকালীন পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল ধারণা দিয়ে, যাকে তাঁরা ভবিষ্যতের উন্নতিশীল ধারণা বলে গণ্য করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিঘাতের ফলে এ সময় (১৮০০-১৮৩০) বাঙালি বিজ্ঞজনদের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে একটা টানাপোড়েন লক্ষ্য করা গেলেও আশাবাদী একটি গোষ্ঠী, ভিনদেশীয় ভাবধারা এবং অসন্তোষজনক দেশীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস চালান। তাঁরা ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ফলকে দেশীয় সাজে ব্যবহার করার উদ্দেশে ব্রিটিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং মিশনারিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে প্রাচ্যবিদদের চিন্তাভাবনা ও জীবনধারাও অনেকটা ভারতীয় হয়ে উঠে। এ ব্যাপারে সহায়ক হয় ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে স্থানিক দূরত্ব। এভাবে প্রাচ্যবিদদের আমলে পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে ভারতীয় মনোভাব অনুকূল হলে ইউরোপীয় ও
ভারতীয়দের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এটা ভারতীয় সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিষয়ে বাঙালি বিদ্বানদের মনে ইতিবাচক প্রত্যাশার জন্ম দেয়। উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বাঙালি বিদ্বানের পদ্ধতিগতভাবে চারটি স্তরে গড়ে তোলেন। প্রথমত, তাঁরা বাংলা গদ্যভাষা ও নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যাত ধ্রুপদী যুগের পুনরাবিষ্কার করেন।
যার সাথে রয়েছে গ্রিস ও রোমের গৌরবময় ঐশ্বর্য্যের সমতুল্যতা সনাক্তকরণ। তৃতীয়ত, ভারতীয় বিদ্বানেরা নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থার সাথে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের দেওয়া প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। চতুর্থত, বৈশ্বিক প্রগতি সম্পর্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উপনীত হন যার উপর নির্ভরশীল ছিল তাঁদের প্রত্যাশা। সত্য যে, এ নতুন প্রত্যাশার ধারায় তাঁরা অতীতকে পুনরুদ্ধার করতে অনাগ্রহী কিন্তু ভবিষ্যতের মধ্যে স্বর্ণযুগকে তুলে ধরতে সচেষ্ট।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, উনিশ শতকের মধ্যপূর্বে কলকাতা পরিণত হয় প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞানের পাদপীঠরূপে। নানা বিষয়ের নতুন নতুন গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রের নিয়মিত হকাশে যে পরিমণ্ডল গড়ে উঠে তাতে একটি অসাধারণ সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়, অনুভবে আর অনুভূতিতে যার প্রকাশ উনিশ শতকের পূর্বে দেখা যায়নি। এসব চিন্তাভাবনার পাশাপাশি পেশাদারদের মধ্যেও একটি সামাজিক অখণ্ডতা ও ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। এ পেশাদারদের উদ্ভব ঘটে প্রধানত পশ্চিমাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে, যাঁরা ছিলেন শিক্ষায় এবং কারিগরি দক্ষতায় বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের দক্ষতা ও পেশাগত পদমর্যাদা স্থানীয়দের অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষা পরিণত হয় বৈষয়িক উন্নতি ও আকাঙ্ক্ষিত মূল্যবান বস্তুতে। এ সামাজিক মননশীল অভিযাত্রা শুধু কলকাতা বা বঙ্গদেশেই আবদ্ধ থাকেনি, বোম্বাই ও মাদ্রাজের মতো ভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও ছাড়িয়ে পড়ে।