বেগম রোকেয়ার সময় বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লেখ।
অথবা, বেগম রোকেয়ার সময় বাংলার হিন্দু-মুসলমান সামাজিক অবস্থার তুলনা কর।
অথবা, বেগম রোকেয়ার সময় তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সমাজের চিত্র তুলে ধর।
উত্তর।। ভূমিকা : ঊনবিংশ শতকে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সমাজের প্রতি ইংরেজদের পক্ষপাতিত্বের নীতি বিরাজমান ছিল। তৎকালীন সময়ে মুসলিম সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনগ্রসর। বেগম রোকেয়া তেমনই এক সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। তবে হিন্দু সমাজ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করে।
বেগম রোকেয়ার সময় বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা : ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে ভাগ্য বিপর্যয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজ অধিকারের পর থেকে অবিভক্ত ভারত তথা বাংলাদেশের মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের সূচনা।মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতন সমাজকাঠামোকে অত্যন্ত দুর্বল করে ফেলে। ফলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানগণ পরাজিত হতে থাকে। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায় অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ছিল। এদেশে ইংরেজ সরকার কর্তৃক শিক্ষাবিস্তার কার্যক্রমের ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায়, মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮০০ সালে ইংরেজ সিভিলিয়ান
কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮২৯ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস খোলা হয় এবং ১৮৩৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি অবশ্য পাঠ্য করা হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা না থাকলেও মূলত আর্থিক সংগতির অভাবেই মুসলমান ছাত্ররা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিল। বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও পিছিয়ে ছিল না। রামমোহন রায়, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার, স্যার হাইড ইস্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮১৬ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার উদীয়মান হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত যুগ পুরুষের আবির্ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তার ত্বরান্বিত হয়েছিল, সে যুগে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ অনেক পিছিয়েছিল। বাংলার মুসলমান সমাজে তখনও পর্যন্ত রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় যুগ গুরুষের আবির্ভাব ঘটে নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠার জন্য উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভিব্যক্তি হিসেবে কোন সংঘ বা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। অথচ ধীরগতিতে হলেও উনিশ শতকের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের মধ্যে জাগরণের সাড়া সৃষ্টি হয়। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তারা চাকরির ক্ষেত্রে একচ্ছত্র সুবিধা ভোগ করতে থাকে। রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভা (১৮১৫), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯), ডক্টর মুয়াটের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্বোৎসাহিনী সভা (১৮৫৩), কিশোরী চাঁদ মিত্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সুহৃদ সমিতি (১৮৫৪) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্র হিন্দুসমাজের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। সভাসমিতি ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-স্ব সমাজের উন্নতি সাধনে ছিল তৎপর। ইংরেজ শাসকবর্গের সাথে আপস আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের উন্নতি সাধনে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ফলে বাংলার হিন্দু সমাজ স্বল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞানে, কর্মে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবের প্রাক্কালে যুগ ও পরিবেশের সার্বিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। বিশেষ করে বাংলার মুসলিম সমাজের অবস্থা ছিল শোচনীয়, শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কোন ক্ষেত্রেই উন্নত অবস্থা ছিল না। সমাজে নারীদের ক্ষেত্রটি ছিল আরও শোচনীয়।