বেগম রোকেয়ার সময়ে সমাজে নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায়গুলো আলোচনা কর।
অথবা, উনিশ শতকে বাংলায় নারীসমাজ শিক্ষায় অনগ্রসরতার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বাংলায় নারী জাগরণে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সমস্ত জীবনের আন্তরিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। নারীমুক্তির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলার মুসলমান নারীসমাজ তথা দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে তিনি অসীম পুণ্যের অধিকারী হয়েছেন। তিনি যেমন নারী জাগরণে অগ্রদূতী তেমনি তিনি পুণ্যময়ী। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার কূপমণ্ডূক মুসলমান নারীসমাজকে তিনিই সর্বপ্রথম মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তিনিই প্রথম মুক্তিপথে বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। এ কারণে তিনি বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে আলোর দিশারী হয়ে থাকবেন।
জন্মপরিচয় : বেগম রোকেয়া উনিশ শতকের শেষভাগে ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়া যে বংশের কন্যা তা ‘সানির’ বংশ নামে খ্যাত। তাঁর পিতার নাম মুহম্মদ নূহ সাবের আবুল কামু সাবের জহিরুদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। বেগম রোকেয়ার মায়ের নাম রাহাতান্নেছা সাবের চৌধুরানী। ভারতের বিহার প্রদেশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়েছিল। তাঁর
স্বামীর নাম সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
মৃত্যু : বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর ভোর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। নিম্নে বেগম রোকেয়ার সময়ে তৎকালীন সমাজে নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায়গুলো আলোচনা করা হলো।
১, সামাজিক অবস্থা : সে সময় মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলো দান করার গুরুত্ব পুরুষ সমাজ উপলব্ধি করতে পারে নি। সে সময়ে লেখাপড়া মুসলমান সমাজের এক সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। অভিজাত মুসলমান পরিবারের মেয়েদের জন্য ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানদানের জন্য আরবি ভাষা শিক্ষা নয়, শুধু কুরআন পাঠ করানোর ব্যবস্থা ছিল। টিয়া পাখির মুখস্থ বুলির মত তারা পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত উচ্চারণ করত। এর অর্থ তাদের শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অভিজাত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের বাংলা কিংবা ইংরেজি বর্ণ পরিচয় শেখানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েদের লেখাপড়া শেখার প্রচেষ্টাকে বিরূণ করে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা বলতেন লেখাপড়া শিখে মেয়ে জাজ ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
২. সামাজিক কুপ্রথা : নারী শিক্ষার আর একটি প্রধান অন্তরায় সামাজিক কিছু বুপ্রথা বা রীতিনীতি। তাদের পর্দা প্রথার নামে অবরোধবন্দিনী করে রাখা হয়েছিল। মেয়েদের যখন তখন ঘরের বাইরে যাবার রীতি ছিল না। মোটকথা তারা গৃহবন্দি ছিল। সে কারণে তাদের পক্ষে শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না।
৩. সামাজিক সচেতনতা : তৎকালীন সামাজিক প্রথা অনুযায়ী নারী থাকবে পর্দার আড়ালে। তাদের সবার সামনে আসার নিয়ম নেই। তারা রান্না-বান্না, পরিবারের সদস্যদের যত্ন করা, কুরআন শরীফ মুখস্থ করা ও অন্যান্য সেলাই এর কাজে পারদর্শী হবে। তৎকালীন সমাজে নারীদের চরম লক্ষ্য বিবাহিত জীবন তথা সংসার ধর্ম পালন করা, কিন্তু এটা নারীর জীবনের চরম লক্ষ্য নয়, তার আরও অনেক কিছু করার আছে। অনেক দায়িত্ব নেওয়ার আছে। সে সচেতনতা তৎকালীন সমাজ প্রথার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।
৪. মানসিক শক্তির অভাব : সে সময়ে নারীসমাজে শিক্ষাহীনতার আর একটি কারণ আত্মনির্ভরতা ছেড়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুষের নিত্যন্ত মুখাপেক্ষী হওয়ায় বিপদসঙ্কুল সংসারে সবসময় সুরক্ষিত থাকায় নারী সাহস, ভরসা, বল একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। শোচনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করার শক্তিটুকুও তাদের নেই। কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার শক্তিও তাদের নেই। তারা মানসিকভাবে নিজেদের এতটাই পঙ্গু করে ফেলেছে। মানসিক শক্তির এ অভাব তাদের শিক্ষা অর্জনের সবচেয়ে বড় বাধা।
৫. দাসীসুলভ মনোভাব : নারী শিক্ষার অন্তরায় শুধু যে সুযোগ সুবিধার অভাব তাই নয়, দাসীসুলভ মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। বিশেষ করে নারীর মানসিক দাসত্ব, স্বাবলম্বন ও সমাজে যথাযোগ্য ভূমিকা গ্রহণে সাহসের অভাবও গভীরতর করেছে নারী অধঃপতনকে।
৬. নিষ্ক্রিয়তা : নারী শিক্ষার অন্তরায় হিসেবে নিষ্ক্রিয়তা একটি কারণ। সমাজে নারীরা কোন কাজে, কোন দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে যেন তারা অবসর গ্রহণ করেছে।
৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব : নারী শিক্ষার অন্তরায় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবও একটি কারণ। সে সময় আমাদের দেশে স্কুল কলেজ একপ্রকার ছিলই না।
৮, ধর্মীয় গোঁড়ামি : সে সময় নারী শিক্ষার অনগ্রসরতার কারণ হিসেবে ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকাংশে দায়ী। ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের পর্দার আড়ালে রেখে গৃহবন্দি করা হতো। তাদের কুরআন পাঠ ছাড়া বাংলা, ইংরেজি বর্ণ শেখা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৯. পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ : সে সময় পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ ছিল নারী শিক্ষা অর্জনের সম্পূর্ণ বিপরীতে। পরিবার পরিজনরা শিক্ষায় উৎসাহ দান করা দূরে থাক বরং উপহাস করত। পরিবারের লোকদের স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী মনোভাব ছিল অনেক বেশি। পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ নারীর ক্ষমতার মধ্যে ছিল না।
১০. অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতা : শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। অন্ন, বক্স, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার মত শিক্ষাও মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সে সময় নারীর মধ্যে ছিল না। তাদের মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলো বিনষ্ট হয়েছিল। যার ফলে তাদের অধিকারবোধটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছিল।
১১. পুরুষশাসিত সমাজ : আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত, এর মধ্যে শিক্ষা একটি। নারী ও পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও সমাজের একটা বৃহৎ অংশ সব ধরনের অধিকার বঞ্চিত।
১২. নারীর অনাগ্রহতা ও উদাসীনতা : শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অনাগ্রহতা ও উদাসীনতা নারী শিক্ষার আর একটি প্রধান অন্তরায়। তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পর্কে সচেতন নয়।
পর্যালোচনা : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, নারী শিক্ষার পশ্চাতে যে অন্তরায়গুলো আছে তা বেগম রোকেয়া অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। নারীসমাজের মুক্তির জন্য শিক্ষা আবশ্যক। আর শিক্ষার আলো ছাড়া কূপমণ্ডূক ও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা নারীসমাজ যারা দাসত্বের শৃঙ্খলে নিজেদের সত্তা বিসর্জন দিয়েছে।তাদের টেনে বের করা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার এ প্রধান অন্তরায়গুলো দূর করে নারী জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে সমাজের তথা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা ছাড়া যে মুসলমান জাতির চক্ষুরুন্মীলন এবং মুসলমান জাতির অর্ধেক নারীসমাজে কূপমণ্ডূক ও অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে যে জাতীয় জাগরণ সম্ভব নয়, এ সত্য কথাটি বেগম রোকেয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই বাংলায় মুসলমান নারীসমাজের মধ্যে শিক্ষা কিভাবে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে সেটিই ছিল বেগম রোকেয়ার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই তিনি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় ছিল সেগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে তার সুষ্ঠু সমাধানের পন্থা নির্ণয়ের জন্য সর্বদা সচেতন ছিলেন। নারীসমাজের মুক্তি শুধুমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব এ বিশ্বাস তাঁর অন্তরে দৃঢ়মূল হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কিত কার্যক্রমের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। তিনি মুসলমান নারীসমাজের অধঃপতিত অবস্থা দূর করার জন্য শিক্ষার যে গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অন্তরায়গুলো আছে তা উদ্ভাবন করে প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন। তার প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রসংশনীয়। তাই নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।