বেগম রোকেয়ার ‘মুসলিম নারী সমিতি’ বা ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ গঠনের উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলি আলোচনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিণী। তাঁর সমস্ত জীবনে আন্তরিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। নারীসমাজের দুরবস্থা ও অধঃপতনের সঠিক কারণ চিহ্নিত করে তিনি দেখেছেন শিক্ষা ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব নয়। নারীর দুরবস্থার একমাত্র প্রতিকার যে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার সে সম্পর্কে রোকেয়ার মনের বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সমাজের পশ্চাৎপদতা,কূপমণ্ডূকতা ও প্রচলিত কুসংস্কারগুলো দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন স্ত্রীশিক্ষা। অথচ তৎকালীন সমাজ ছিল প্রধানতন্ত্রী শিক্ষাবিরোধী। সমাজের স্বার্থে নারীসমাজকে শিক্ষাদান করা দরকার। কারণ তাদের শিক্ষা ছাড়া সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব। তাই নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের লক্ষ্যে শিক্ষাবিস্তার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন এ শিক্ষাবিস্তার তথা নারী জাগরণ কর্মকাণ্ডে। নারী মুক্তিই ছিল তাঁর সারাজীবনের স্বপ্ন।
জন্মবৃত্তান্ত : বেগম রোকেয়া উনিশ শতকের শেষভাগে ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্ত গর্ত পায়রাবন্দ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়া যে বংশের কন্যা তা ‘সাবির’ বংশ নামে খ্যাত। তাঁর পিতার পুরো নাম মুহম্মদ নূহ সাবের আবুল কামু সাবের জহিরুদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। বেগম রোকেয়ার মায়ের নাম রাহাতান্নেছা সাবেরা চৌধুরানী। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্বামীর নাম সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপনের পটভূমি : মুসলিম বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উনিশ শতকের শেষভাগে মুসলমান মেয়েদের চলার পথকে সুগম করার জন্য মুসলমান ছেলেরা আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিল। তারা তাদের পাঠ্যজীবনে ১৮৮২ সালে ঢাকায় ‘সুহৃদ সম্মিলনী’ নামে এক সমিতি স্থাপন করেন। এ সমিতির উদ্যোক্তাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন নোয়াখালীর মৌলবি আব্দুল আজিজ, মৌলবি ফজলুল করীম, মৌলবি বজলুর রহিম ও বরিশালের মৌলবি হিমাসিৎ উদ্দিন প্রবে। তারা বাংলার বিভিন্ন অংশের মেয়েদের ঘরে ঘরে অন্তঃপুরে শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন। ১৯৮৮ সালের পর সু সম্মিলনী সম্পর্কে যার কিছু জানা যায় নি। উনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৮৭ সালে নেতৃস্থানীয় হিন্দু মহিলাদের দ্বারা ‘সুখি সমিতি’ নামে একট প্রতিষ্টান গঠিত হয়েছিল। সমিতিটির প্রতিষ্ঠাত্রী ও সম্পাদিকা ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সুকন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবীর জাতিগঠনমূলক কার্যকলাপ প্রধানত হিন্দু নারীই সীমাবদ্ধ ছিল। এ প্রতিষ্ঠানটি নারীর শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে ব্যাপক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল কি না তা জানা যায় নি।
বেগম রোকেয়ার মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপনের উদ্দেশ্য : বিশ শতকের প্রথমার্ধে মুসলমান নারীসমাজের জন্য একটি পৃথক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় স্থাপিত হয় আঞ্জুমানে যাওয়াতীনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি। মুসলিম নারীসমাজের পশ্চাৎপদতার কারণগুলো বেগম রোকেয়া অন্তর নিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। মুসলমান নারীসমাজে যুগ যুগ ধরে যে সমস্ত প্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে, সেগুলো নূরীভূত করে মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের মহতী উদ্দেশ্যে তিনি আঞ্জুমানে যাওয়াতীনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার জীবনব্যাপী সাধনার অন্যতম বিশিষ্ট ক্ষেত্র ছিল এ
বেগম রোকেয়ার মুসলিম মহিলা সমিতির কার্যাবলি : জাতিগঠনমূলক কাজে মুসলিম মহিলা সমিতি স্মরণীয় হয়ে
আহ। আনান অজন বিধবা মেয়েকে অর্থ দান করেছে। চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে বহু অসহায় গৃহবধূকে রক্ষা করেছে, বরংপ্রাপ্ত পরিত্র কুমারীকে সৎপাত্রস্থ করেছে, অভাব্যস্ত মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণে নানাভাবে সাহায্য করেছে। সমাজ পরিত্যক্তা দুই মহিলা এবং অনাথ শিশুদের সাহায্যার্থে আঞ্জুমান বাস্তর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বাংলার অবরোধবন্দিনী মুসলামান নারীসমাজকে গৃহের অন্ধকার কোন থেকে বাইরের দীপ্ত আলোয় আনা এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণাকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মুসলিম নারী সমিতির প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। মুসলিম নারী সমিতির কার্যাবলি সম্পর্কে লোন রোকেয়া বলেছেন, “কলকাতার মুসলমান নারীসমাজের গত বিশ বৎসরের জান্নাতির বারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা করলে স্পষ্টই বুঝা যায় এ সমিতি দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর আড়ালে মুসলমান সমাজকে কতখানি বণী করে রেখেছে।” বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে তাদের দুর্গতি সম্বন্ধে সচেতন করে ন্যায্য অধিকার আবারের জন্য আকুমানের কন্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত সোচ্ছার। বস্তুত কোন রোকেয়া নূঢ় মনোবলের অধিকারিণী ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আধুনিক শিক্ষার প্রচার ও আঙুমানের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণমূলক হয়েছিল। শিক্ষা সংক্রান্ত সর্বতির গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণেও ছিল তার সমান আগ্রহ।তিনি নারীমুক্তির আহূত ব্যাবেশেও যোগদান করতেন।
পর্যালোচনা : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বেগম রোকেয়া দেশ ও জাতির স্বার্থে নারামুক্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলার মুসলমান নারীসমাজের সংগঠন ‘আহুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ সমিতির উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি এতটাই ফলপ্রসূ যে, কলকাতার মুসলমান নারীসমাজের গত বিশ্ব বছরের ক্রমোন্নতির ধারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা করলে স্পষ্টই বুঝা যায় এ সমিতি মুসলমান সমাজকে কতটা ঋণী করেছে। এ কথা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে, বেগম রোকেয়া নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণমূলক যে কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন একমাত্র তা মুসলিম নারীসমাজে জাগরণের ও মুক্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। পাষাণ কারা ভেঙে গেছে।অবরোধের প্রাচীর মুসলমান মেয়েদের আর আবদ্ধ করে রাখতে পারছে না। যুগ যুগান্তের পুঞ্জীভূত অন্ধকার ভেদ করে মুসলিম নারী আলোর রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এ প্রবেশ যেমন বিস্ময়কর তেমনি আশাপ্রদ। মুসলিম নারীর জীবন ও মন আজ যেভাবে যতটুকু বিকশিত হয়েছে তাঁর লেই রয়েছে বেগম রোকেয়ার আজীবনের সাধনা। একথাও সত্যি যে, বাংলার মুসলমান নারীসমাজের উন্নতির জন্য সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল এবং আনুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম এই উভয় প্রতিষ্ঠান প্রভূত সহায়তা করেছে।
সমালোচনা : বেগম রোকেয়া দেশ ও জাতির স্বার্থে নারীমুক্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য বাংলার মুসলমান নারীসমাজের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমালোচকগণ বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের বিকৃত ব্যাখ্যা দান করে বলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলন প্রভাবান্বিত হয় নি। তিনি যে শিক্ষা প্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন তা পাশ্চাত্য শিক্ষার স্পর্শযুক্ত। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত নারীমুক্তি আন্দোলন তাদের মতে নগ্নতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য।
মন্তব্য: মুসলিম বাংলার নবজাগতির মূলে পাশ্চাত্য শিক্ষার ও সংস্কৃতির কোন প্রভাবই কি নেই? কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব থাকার দরুনই কি সমাজজীবনে নগ্নতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয়। তারা এ সহজ সত্যকে কিভাবে অস্বীকার করেন যে, বাঙালির নবজাগতির মূলেই রয়েছে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সংস্কৃতির অনিবার্য প্রভাব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, বেগম রোকেয়ার প্রতিভায় বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাবেশ লক্ষণীয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে তার মনের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল। জাতির বৃহত্তর কল্যাণ কামনায় সমাজদেহের অপরিহার্য অঙ্গ নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্যে তিনি অন্তরে প্রবল আবেগ অনুভব করেছিলেন।শিক্ষাপ্রচার আন্দোলন ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে অভিযান সফল করে তোলার জন্য তিনি শক্তিশালী হাতে লেখনী ধারণ করেছিলেন। তাঁর জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যচর্চার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।ধ্রুবতারার মত একটি লক্ষ্যের প্রতি তার সমস্ত কর্ম পরিচালিত হয়েছিল, সে লক্ষ্য নারী জাগরণ।