Answer

বেগম রোকেয়ার মুক্তির দর্শন আলোচনা করো। তাঁর নারী মুক্তি দর্শন কী নারীবাদ?

অথবা, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর। তাঁর নারীমুক্তির আন্দোলনকে কী নারীবাদী আন্দোলন বলা যায়?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি দর্শন ও সাহিত্যে তৎকালীন সময়ে তাঁর আবির্ভাব বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান মনস্ক, মুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, নারীকল্যাণ প্রত্যাশী এক আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন নারী। তাঁর জীবন ও কর্মে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং মনমানসিকতা প্রস্ফুটিত। তাঁর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে তাতে দার্শনিক চিন্তা লক্ষ্য করা যায়। বেগম রোকেয়া সারাজীবন নারী কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। নারীকে শিক্ষিত করে তোলার মাধ্যমে তিনি সমাজে পুরুষের অর্ধাঙ্গী রূপে দেখতে চেয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শন : পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মত বেগম রোকেয়া কোন বিশেষ তত্ত্ব রচনা করেন নি,তবুও তিনি জীবন ও কর্ম দ্বারা বাঙালি দর্শনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি মূলত একজন সংস্কারক। অনগ্রসর মুসলিম নারী জাতির দুর্দশা অনুধাবন করে তিনি নারীমুক্তির দর্শন রচনা করেন। আর এ দর্শন তাঁর কর্মজীবনের নানা সংস্কারমূলক কার্যাবলি ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। নিম্নে বেগম রোকেয়ার নারীবাদী বা নারীমুক্তির দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
নারীবাদ বা নারীমুক্তির দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, Mary Wollstonecraft তাঁর A Vindication of the Rights of women’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবস্থানগত, প্রাপ্তিগত ও বৈষম্যমূলক অবস্থানের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেন এবং নারী মুক্তির প্রথম সুপরিকল্পিত প্রস্তাব ঘোষণা করেন। নারীমুক্তির দর্শনের কেন্দ্রীয় প্রত্যয় ‘নারীর ক্ষমতায়ন” পাশ্চাত্যের মত আমাদের দর্শন রচনায় অগ্রগামী একজন দার্শনিক। Mary Wollstorf এর A vindication of the Rights of Women’ গ্রন্থে যেভাবে নারীর প্রকৃতিগত দুর্বলতা, নমনীয়তা,প্রেমকলা, রূপচর্চা জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে। বেগম রোকেয়ার রচিত গ্রন্থেও অনুরূপ আলোচনা করা হয়েছে। তিনি শুধু আলোচনা-সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, বাস্তবকে মেনে নিয়ে নারী জাগরণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করছেন। তিনি তৎকালীন মুসলমান সমাজে যৌক্তিক ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে নারীসমাজের এক নির্মম “দাসী” চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “পাঠিকাগণ। আপনারা কি কোনোদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি দার্সী! পৃথিবী হতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? আমরা দাসী কেন? কারণ আছে?”
বেগম রোকেয়ার সমাজ দর্শনের প্রেক্ষাপট হলো ভারতীয় সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘নারীর জীবন’। নারীর সার্বঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে সচেতন সঙ্গিনীরূপে পুরুষের পাশে চলার উপযুক্ত করে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এটাই তার জীবনের মূল্য লক্ষ্য ছিল। নারীর মানবীয় সত্ত্বার বিকাশের জন্য নারীর শিক্ষার পথ প্রসার এবং অবরোধ প্রথার অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি “অর্ধাঙ্গী” প্রবন্ধে বলেন, “শারীরিক শক্তিতে নারী অপেক্ষাকৃত দুর্বল। শুধু এ কারণেই স্বামী স্ত্রীর প্রভু হতে পারে না। কেননা নারী ও পুরুষ উভয়কেই উভয়ের উপর নির্ভর করতে হয়, সে হিসেবে উভয়ের মূল্য সমান।”
বেগম রোকেয়া পদ্মরাগ উপন্যাসের নায়িকা জয়নাবের চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলেন, ‘আমি সমাজকে দেখাতে চাই একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে। সংসার ধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে।” তিনি মনে করেন ধর্মের দোহাই দিয়ে, শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নারীর উপর পুরুষ আধিপত্য বিস্তার করে। তাঁর মতে, নারী জাতির অবনতির মূল কারণ হলো পুরুষতান্ত্রিক শাসন এবং নারীর সুযোগ সুবিধার অভাব। তিনি নারীর অবনত অবস্থার জন্য নারীর অসচেতনতা, নিষ্ক্রিয়তা, দায়িত্বহীনতা ও মানসিক দৃঢ়তার অভাবকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি নারী জাতির অবস্থা উন্নয়নের জন্য তাদের নিজেদের এগিয়ে আসার উপর জোর দেন। তিনি উল্লেখ করেন, “ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করেন, যে নিজে নিজেকে সাহায্য করে।” তিনি নারী জাতিকে ভগিনী সম্বোধন করে আহ্বান করেন। অতএব, জাগো জাগো গো ভগিনী। বেগম রোকেয়া এ আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছে স্কুল, গঠন করেছিলেন আঞ্জুমান খাওয়াতীন ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি। নারীমুক্তির জন্য তিনি গড়ে তোলেন সংস্কার আন্দোলন।
বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন নারীবাদ কি না : বেগম রোকেয়ার কর্মজীবন ও সাহিত্য কর্ম বিচারবিশ্লেষণ করার মাধ্যমে তাঁর নারীমুক্তির দর্শনকে নারীবাদ বলা যায় কি না তার উত্তর অনুসন্ধান করতে হবে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তার নারী গ্রন্থে বলেন, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন “নারীবাদী” এবং নারী মুক্তির আন্দোলনে তার ভাবমূর্তি “নারীবাদী”। তিনি কোম
রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, “Mary Wollstonecraft” অপেক্ষা অধিক কট্টর নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলি ভরে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ঘৃণা।”
“বাংলাদেশের নারী” গ্রন্থে বেবী মওদুদ বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী আখ্যায়িত করেন। তবে বেগম রোকেয়ার নারীবাদ যৌনাশ্রয়ী নারীবাদের তুলনায় পৃথক এটাও বলেন। তার নারীবাদের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর মুক্তি। বেগম রোকেয়া নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষকে দুরাচার দুশ্চরিত্র পর্যন্ত বলেছেন। পুরুষ বিদ্বেষের পাশাপাশি তিনি কোন কোন পুরুষের সহমর্মিতার ও সহযোগিতার কথাও বলেছেন। নারীর সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর রচনায় পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। নারীর স্বাধীনতা বলতে তিনি পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা অর্জন করার কথা বলেছেন। পুরুষকে বাদ দিয়ে নারীর পূর্ণস্বায়ত্বশাসনকে বুঝান নি। তৎকালীন সমাজে নারী জাগরণে তাঁর ভূমিকাকে অধিকাংশ বিশ্লেষক নারীবাদ হিসেবেই অভিহিত করেন। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক নারীবাদের পরিবর্তে নারী জাগরণের কর্মী হিসেবে বেগম রোকেয়াকে আখ্যায়িত করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, বেগম রোকেয়া সারাজীবন নারীমুক্তির জন্য কাজ করেছেন। তাঁর নারীমুক্তি বা নারী জাগরণমূলক কর্মকাণ্ডকে অনেকে নারীবাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূলত বেগম রোকেয়া নারীবাদী ভাবধারার অনুসারী হলেও তা পাশ্চাত্য নারীবাদের মতো বা বর্তমানে সমাজে প্রচলিত আপত্তিকর নারীবাদের মতো ছিল না। তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার সাথে তিনি নারীবাদকে দেখেছেন নারীজাগরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে।তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হয়েও ধর্মকে বর্জন করেন নি। ধর্মের তিনি গোড়ামীকে কটাক্ষ করেছেন কিন্তু ধর্মকে অস্বীকার করে নয়। তাই প্রচলিত অর্থে তাকে নারীবাদী বলা যুক্তিযুক্ত নয়।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!