Answer

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন বলতে কী বুঝ? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সদস্য হিসেবে কাজী আব্দুল ওদুদের দর্শন ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কী? কাজী আব্দুল ওদুদের চিন্তাধারার আলোকে বাংলাদেশ দর্শনে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অবদান বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
ধর্মকে দার্শনিক আলোকে দেখার এবং সার্থক ও সফল জীবন রচনার যে প্রয়াস তা শুধু উনিশ শতকের শুরুতেই পরিলক্ষিত হয় তা বলা যাবে না। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখের মতো প্রগতিশীল চিন্তার লোক পরবর্তীতেও অনেক দেখা যায়। এ রকমই একটি প্রগতিশীল দার্শনিক আন্দোলন হচ্ছে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। আর এ আন্দোলনের মূল প্রাণশক্তি হিসেবে যিনি কাজ করেছেন তিনি কাজী আব্দুল ওদুদ।
কাজী আব্দুল ওদুদের দর্শন চিন্তা : মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা ও মননশীল লেখক হিসেবে আব্দুল ওদুদ বাঙালি সমাজে সুপরিচিত ছিলেন। জার্মান কবি গ্যাটে, রাজা রামমোহন রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাচেতনা দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগ্রত করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। নিম্নে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন মুক্তবুদ্ধি চর্চার সমর্থক হিসেবে কাজী আব্দুল ওদুদ চিন্তার জগতে যে অবদান রেখেছেন তা বর্ণনা করা হলো :
১. যুক্তিবাদিতা : বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কাজী আব্দুল ওদুদ ছিলেন মনেপ্রাণে একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি যুক্তিকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “সাহিত্য সমাজ শুদ্ধ জ্ঞান ও চিন্তা চর্চা করেনি; তা ছিল স্বাধীন ও মুক্ত। এতে কোনো ভাবাবেগ বা উগ্র মনোভাব ছিল না। এর পিছনে যুক্তিবাদী মন এবং সত্য সন্ধানী দৃষ্টি ছিল।” উনিশ শতকের ইয়ং বেঙ্গলদের সাথে মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটা মিল লক্ষ্য করা গেলেও এ দুই দার্শনিক
আন্দোলনের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এ সম্পর্কে ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনে যুক্তিবাদ ছিল, ভাবাবেগও ছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে আবেগের স্থান ছিল না। শিখা গোষ্ঠী উগ্রপন্থি ছিল না। তাঁরা সমাজের আমূল পরিবর্তন চান নি। তাঁরা জেমসের আদর্শে সমাজের Renovation বা নবজীবন চেয়েছেন।”
আব্দুল ওদুদ বিনা বিচারে কোনো মতকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করেননি। তিনি বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমেই কোনো মতকে গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ উক্তিটিকে সমর্থন করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধে বলেছেন, “সকল ধর্ম সত্য, এটি একটি শিথিল চিন্তা মাত্র। তার চাইতে সকল ধর্মের ভিতরেই যথেষ্ট মিথ্যা বা অসার্থক ভাবনা রয়েছে, মানুষকে সেসব কাটিয়ে উঠতে হবে ও চিন্তারই সত্যিকার মর্যাদা। ধর্মের অপর নাম মনুষ্যত্ব সাধন, আনুষ্ঠানিক ধর্ম যদি মনুষ্যত্ব সাধনের সহায় হয় তবেই তা ধর্ম
নইলে তা আচার-অনুষ্ঠান মাত্র।”
আব্দুল ওদুদের যুক্তিনির্ভর মানসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে আবুল ফজল বলেছেন, “শুভ বুদ্ধির সাথে যুক্তি নির্ভরতাই কাজী আব্দুল ওদুদের রচনার বৈশিষ্ট্য। যুক্তিহীন কুসংস্কার ও বুদ্ধিহীনের বিরুদ্ধে তিনি চির আপসহীন।রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় সমস্ত দেশ যখন দিশেহারা, দেশের সে দুঃসময়েও যুক্তিহীন ভাবাবেগে তিনি কখনও ছিন্নমূল হননি, হননি বিচলিত। ইংরেজিতে Rationalist বলতে যা বুঝায়, আমাদের সাহিত্যিক আব্দুল ওদুদ তাই।”
২. মানবতাবাদ : কাজী আব্দুল ওদুদ একজন মানবতাবাদী দার্শনিক ছিলেন। তিনি সকল রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান করেছেন। তাঁর মানবতাবাদের পরিচয় পাওয়া যায় তার বিভিন্ন রচনায়। তিনি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে সংঘর্ষ পছন্দ করতেন না। তিনি সব কিছুর মধ্যে শান্তি অন্বেষণ করেছেন। কারণ দ্বন্দ্ব সংঘাত কখনও শান্তি এনে দিতে পারে না। পারস্পরিক সম্প্রীতিই মানুষের শান্তির পথ খুলে দিতে পারে। তাই তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতা জাগ্রত করার কাজ করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজল বলেছেন, ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত, দেশ ও জাতিগত সকল রকমের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠার Wisdom এর পরিচয় পাওয়া যায় আব্দুল ওদুদের রচনায়। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি কখনও রেহাই দেননি, করেননি এতটুকু বরদাস্ত। ওদুদ সম্পর্কে অন্নদা শংকর রায়ের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, “সাম্প্রদায়িকতার এত বড় শত্রু দেশে আর দ্বিতীয়টি আছে কি
না সন্দেহ।”
৩. রাষ্ট্রদর্শন : কাজী আব্দুল ওদুদের রাষ্ট্রচিন্তা তাঁর বিরাট দার্শনিক প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। তিনি গান্ধীর অহিংসা রাজনীতির সাথে সমর্থন প্রকাশ করেন। গান্ধী যেমন অহিংস নীতিটিকে রাজনীতিতেও নিয়ে এসেছিলেন তেমনি কাজী আব্দুল ওদুদ তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় অহিংস নীতি সমর্থন করেন। তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তিকে কখনও সমর্থন করেন নি। তিনি অবিভক্ত ভারতেই শান্তির পথ খুঁজেছেন। তিনি বলেছেন, বিভক্তিতে শান্তি থাকতে পারে না; অবিভক্ত ভারতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মানসিক
উন্নতি করলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। তিনি বলেছেন, যদি ভারত বিভক্তি অত্যাবশ্যকই হয়ে পড়ে, তবে ভাষার ভিত্তিতে তা হওয়া উচিত। তিনি হিন্দু- মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভাগকে সমর্থন করেননি। অসামপ্রদায়িক ভারতীয় অথবা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার বিকাশ তাঁর কাম্য ছিল। তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের সমর্থক ছিলেন না। তিনি যে কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন। শরিয়তের পুনঃপ্রবর্তন যে অসম্ভব সে কথা তিনি স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “শরিয়তের পুনঃপ্রবর্তন অবশ্য অসম্ভব, কেননা অতীত অস্তমিত মৃত তার যে অংশ সজীব সে তুমি ও আমি; অতীত পুনরুজ্জীবিত হবে না।” তিনি জাতীয় জীবনে যেমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তেমনি প্যান ইসলামবাদ সমর্থন করেননি। এ প্রসঙ্গে মুস্তাফা কামাল সম্পর্কে কয়েকটি কথা প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “প্যান ইসলামি চিন্তা মুসলমানকে বহির্মুখী করে তোলে এবং স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি উদাসীন করে। মুসলমানদের স্বদেশ ও স্বজাতির দুঃখ দৈন্যের অবসানের চিন্তা করা উচিত। প্যান ইসলামবাদ নয়; বাস্তব জাতীয়তাবাদই মুসলমানদের কাম্য।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম চিন্তানায়ক কাজী আব্দুল ওদুদ সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার যুক্তিভিত্তিক বিচারবিশ্লেণ করে সুষ্ঠু সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন,যা তাঁর গূঢ় দার্শনিক প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। ধর্ম, সমাজ, রাজনী তি প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়েও তিনি সুন্দর আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। সর্বোপরি বলা যায়, একজন প্রগতিশীল দার্শনিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশ দর্শনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!