বিস্তারের আদর্শ পরিমাপ কোনটি এবং কেন? বিস্তার পরিমাপের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কী?
অথবা, বিস্তারের আদর্শ পরিমাপ কোনটি এবং কেন? বিস্তার পরিমাপের তাৎপর্য লেখ।
অথবা, বিস্তারের আদর্শ পরিমাপ কোনটি এবং কেন? বিস্তার পরিমাপের প্রয়োজনীয়তাসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গড়, মধ্যমা ও প্রচুরকের সাহায্যে গণসংখ্যা নিবেশনের কেন্দ্রীয় মান পরিমাপ করা যায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় মান থেকে তথ্যসারির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সংখ্যার ব্যবধান নির্ণয় করা যায় না। বিস্তার পরিমাপের সাহায্যে তথ্যসারির প্রতিটি সংখ্যামানের অবস্থান জানা যায়। সামাজিক পরিসংখ্যানে কেন্দ্রীয় প্রবণতার পাশাপাশি বিস্তার পরিমাপ ও ব্যাপক গুরুত্ববহ । বিস্তার পরিমাপের সাহায্যে তথ্যসারির প্রতিটি সংখ্যামানের অবস্থান জানা যায়।
আদর্শ বিস্তার পরিমাপ : সাধারণত গড়ের ভিত্তিতেই বিস্তার পরিমাপ করা হয়। তাই কেন্দ্রীয় প্রবণতার পরিমাপের উপযুক্ততার উপর নির্ভর করে বিস্তার পরিমাপের উপযুক্ততা। মোটামুটিভাবে আদর্শ বিস্তার পরিমাপের গুণাবলি বলতে আদর্শ কেন্দ্রীয় প্রবণতার পরিমাপের গুণাবলিকেই বুঝায়। নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো :
১. একটি আদর্শ বিস্তার পরিমাপের অত্যন্ত সুস্পষ্ট থাকতে হবে যাতে একে সহজে বুঝা যায় এবং কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হয় ।
২. ইহা তথ্য সারির সকল মানের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ সকল মানের উপর নির্ভরশীল হলেই তা নির্ভরযোগ্য ও প্রতিনিধিত্বমূলক পরিমাপ হবে।
৩. এটি প্রান্তিক চরমমানসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হবে।
৪. এটি সহজে বীজগাণিতিক প্রক্রিয়া আরোপের এবং ভবিষ্যতে পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে কাজে লাগানোর উপযোগী
৫. আদর্শ বিস্তার পরিমাপ গণনার এবং হিসাবের উপযোগী হতে হবে যাতে তাড়াতাড়ি ভুল না হয়। আদর্শ বিস্তার পরিমাপের উপর্যুক্ত বাঞ্ছনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যসমূহ যে পরিমাপটি ধারণ করে তাকেই আদর্শ পরিমাপ হিসেবে গণ্য করা যাবে। বস্তুত উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, পরিসর সহজে বুঝা যায় ও সহজে গণনা করা যায়। কিন্তু এটি সকল মানের উপর নির্ভরশীল নয়। পরিসর প্রান্তিক মান দ্বারা প্রভাবিত হয়। এতে সহজে গাণিতিক ও বীজগাণিতিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায় না। তাছাড়া এটি নিবেশনের মধ্যক মান থেকে অন্য সংখ্যাগুলোর বিস্তৃতি সম্বন্ধে সঠিক ধারণা দিতে পারে না। অন্যদিকে, চতুর্থ ব্যবধান এমন একটি বিস্তার পরিমাপ যার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে এবং যা নির্ণয় করা সহজ। এটি প্রান্তিক মান দ্বারা কম প্রভাবিত হয় এবং নমুনা বিচ্যুতি দ্বারা পরিসর অপেক্ষা অনেক কম পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এজন্য পরিসর অপেক্ষা চতুর্থক ব্যবধান উৎকৃষ্ট বিস্তার পরিমাপ। তবে চতুর্থক ব্যবধান বীজগাণিতিক প্রক্রিয়া আরোপের অনুপযোগী এবং কোন নির্দিষ্ট গড়ের চতুর্দিকে বিস্তার পরিমাপ করে না। তাছাড়া এটি সকলমানকে বিবেচনায় আনে না। তাই চতুর্থক ব্যবধানকে বিস্তার পরিমাপক হিসেবে তেমন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না। আবার, গড় ব্যবধান প্রকৃত অর্থে বিস্তার পরিমাপক এটি যে কোন একটি গড়ের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয়। মূলত এ গড় ব্যবধান প্রায় সবগুলো বাঞ্ছনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এটি সহজে বুঝা যায় এবং সকল মানের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া এটি নমুনা তারতম্য ও প্রান্তিক মান দ্বারা কম প্রভাবিত হয়। কিন্তু এতে পরবর্তীতে কোন গাণিতিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায় না। তবে এটি যে কোন মূল্যে পরিসর ও চতুর্থক ব্যবধান অপেক্ষা উত্তম। সবিশেষে বিস্তার পরিমাপে ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। উপরে উল্লিখিত একটি আদর্শ বিস্তার পরিমাপের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে পরিমিত ব্যবধান সহজবোধ্যতা ছাড়া প্রায় সবগুলো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এটি ‘সকল মানের উপর নির্ভরশীল। এটিতে অধিক গাণিতিক ও বীজগাণিতিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যায়। এটা নমুনা বিচ্যুতির ক্ষেত্রে প্রায় স্থির থাকে অর্থাৎ এটা নমুনা তারতম্য দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সুতরাং বলা যায় যে, তথ্যরাশির বিচ্যুতির পরিমাপের জন্য উপযুক্ত কয়টি পদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও একটি আদর্শ বিস্তার পরিমাপের নগণ্য কিছু গুণাবলি বাদে সবগুলো গুণাবলি থাকার কারণে পরিমিত ব্যবধানকে একটি আদর্শ পরিমাপক বলা হয় ।
বিস্তার পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা : বিস্তার পরিমাপের সাহায্যে কেন্দ্রীয় মান বা গড় হতে তথ্যের মানগুলোর দূরত্ব বা পার্থক্য নির্ণয় করা হয়। এর ফলে নিবেশনের গড় মানের চতুর্দিকে অন্যান্য মানগুলোর অবস্থান কিরূপ তা বুঝা যায় এবং দু বা ততোধিক নিবেশনের বিস্তৃতি পরিমাপের মাধ্যমে তাদের মধ্যে তুলনা করতে বিস্তার পরিমাপ অত্যাবশ্যক। নিম্নে বিস্তার পরিমাপের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলো :
i. বিস্তার পরিমাপের মাধ্যমে কোন তথ্যসারির মানগুলোর সামঞ্জস্যতা পরিমাপ করা যায়। যে তথ্যসারির বিস্তার যত বেশি তার মানগুলোর পারস্পরিক দূরত্বও তত বেশি অর্থাৎ তত বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমনঃ কোন একটি কোম্পানির একশত টাকা মূল্যমানের শেয়ারের মূল্য পর পর ২০ দিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল মূল্যগুলোর বিস্তার খুবই বেশি। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য অস্থিতিশীল অর্থাৎ এক দিনেরে মূল্যের সাথে অন্য দিনের মূল্যের পার্থক্য যথেষ্ট।
ii. বিস্তার পরিমাপের মাধ্যমে কোন তথ্যসারি বা নিবেশনের কেন্দ্রীয় মান অর্থাৎ গড় মানের যথার্থতা ও প্রতিনিধিত্বশীলতা যাচাই করা যায়।
iii. কোন নিবেশনের অভ্যন্তরীণ ভেদ নির্ণয়ে ও নিয়ন্ত্রণে বিস্তার পরিমাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
iv. যখন কেন্দ্রীয় প্রবণতার বিভিন্ন পরিমাপ যেমন- গড়, মধ্যমা ও প্রচুরক ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্যসারির প্রকৃতি উদ্ভাবনে ব্যর্থ হলে তখন বিস্তার পরিমাপ দ্বারা তথ্যের যথার্থ প্রকৃতি উদ্ভাবন করা যায় ।
v. দুই বা ততোধিক গড়, মধ্যমা ও প্রচুরক সমান হলেও এদের গঠন প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে । এ ধরনের ক্ষেত্রে নিবেশনসমূহের মধ্যে তুলনা করতে বিস্তার পরিমাপ ব্যবহার নিবেশনের কেন্দ্রীয়
প্রবণতার পরিমাপ যেমন- করা হয়।
vi. দুই বা ততোধিক নিবেশনের কেন্দ্রীয় মান পরস্পর অসমান হলেও এদের আকার-আকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্যতা থাকতে পারে । এ ধরনের নিবেশনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় মান এককভাবে তথ্যের প্রকৃতি নির্ণয় করতে পারে না । এজন্য বিস্তার পরিমাপ প্রয়োজন হয় ।
vii. দুই বা ততোধিক নিবেশনের চলকসমূহের একক ভিন্ন ভিন্ন হলে এদের মধ্যে তুলনা করতে কেন্দ্রীয় প্রবণতার পরিমাপ দ্বারা সম্ভব নয় । এ ক্ষেত্রে নিবেশন দুটির মধ্যে তুলনা করতে আপেক্ষিক বিস্তার পরিমাপ ব্যবহৃত হয় ।
viii. নিত্য প্রয়েজনীয় পণ্যের দামের পরিবর্তনশীলতা পরিমাপে বিস্তার পরিমাপ ব্যবহৃত হয় । এছাড়াও পণ্যসমূহের পাইকারী বাজার ও খুচরা বাজারে দামের পার্থক্য নির্ণয়ে বিস্তার পরিমাপ দরকার ।
ix. উৎপাদিত পণ্যের গুনগত মান নিয়ন্ত্রণে বিস্তার পরিমাপ একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অর্থনৈতিক চলকের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্বল্পমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদানে বিস্তার পরিমাপ প্রয়োজন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিস্তার পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম । বিস্তার পরিমাপ হলো সংখ্যা মানগুলোর মধ্যক মান হতে বিস্তার বা পার্থক্যের পরিমাপ। এ বিস্তার পরিমাপের মাধ্যমে মধ্যক মানের প্তিনিধিত্বের একটি সঠিক ধারণা পাওয়া যায় । তাৎপর্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে, তথ্যসারির তুলনা করতে, উচ্চতর পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় মানের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ে প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তার পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । সুতরাং বিস্তার পরিমাপের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা যে অপরিসীম তা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।