বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্প অবলম্বনে অন্নপূর্ণার চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, অন্নপূর্ণার মাতৃহৃদয়ের পরিচয় দাও।
অথবা, “বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁইমাচা’ গল্পের অন্নপূর্ণা সর্বংসহা এক শাশ্বত নারী” এই উক্তির আলোকে অন্নপূর্ণা চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, অন্নপূর্ণা কে? তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।
অথবা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্পের অন্নপূর্ণার মাতৃহৃদয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
‘পুইমাচা’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। এই গল্পে গল্পকার নিম্নবিত্ত বাঙালির অনটনক্লিষ্ট পারিবারিক জীবনের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেছেন। সহায়হরি চাটুয্যের সংসার জীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে গল্পকার সহায়হরির সহধর্মিণী অন্নপূর্ণাকে এক মহীয়সী রমণী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মূলত অন্নপূর্ণাই ‘পুঁইমাচা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
সমগ্র গল্পটি জুড়ে তার অবস্থান তাকে প্রধান চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছে।
কে এই অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণা দরিদ্র ব্রাহ্মণ সহায়হরি চাটুয্যের সহধর্মিণী। আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ সহায়হরির সংসারে অন্নপূর্ণা দায়িত্বশীল স্ত্রীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজের বুক দিয়ে স্বামীর অভাব অনটনের সংসারটিকে আগলে রেখেছেন। জীবনে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেন নি। কিন্তু তাই বলে এ কারণে তাঁর মনে কোন ক্ষোভ ছিল না। স্বামীর সামর্থ্য ও যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন বলেই দাম্পত্য-কলহ তাঁদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ভগবানের ইচ্ছায় অন্নপূর্ণা চার কন্যার হতভাগিনী মা। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না।
সন্তান বাৎসল্য অন্নপূর্ণা : সহায়হরি চাটুয্যের স্ত্রী অন্নপূর্ণা একজন সহজসরল, মমতাময়ী মা। স্বামীর অভাব অনটনের সংসারটিকে তিনি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। ভগবান হয়তো তাঁকে পরীক্ষা করার জন্যই চার চারটি কন্যার জননীতে পরিণত করেছিলেন। কন্যাদেরকে তিনি ঠিকমতো পরিচর্যা করতে না পারলেও তাদের প্রতি অন্নপূর্ণার স্নেহ ভালোবাসার অন্ত ছিল না। জ্যেষ্ঠকন্যা ক্ষেন্তির ভোজপটুতাকে তিনি বিদ্রূপ না করে বরাবর প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন। মেয়েদেরকে তিনি রাজভোগ খাওয়াতে না পারলেও ময়দার গোলা, নারকেলের পিঠে, নারকেল কোরা, পুঁইশাকের চচ্চড়ি প্রভৃতি যত্নসহকারে তৈরি করে খাইয়েছেন। তাঁর সন্তান-বাৎসল্য সমাজের অনুশাসন ও পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে কখনও বাধাগ্রস্ত হয়নি।
সমাজসচেতন অন্নপূর্ণা : কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বামীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অন্নপূর্ণা ছিলেন সমাজসচেতন রমণী। জ্যেষ্ঠকন্যা ক্ষেন্তির আশীর্বাদ হয়ে বিয়ে না হওয়ার কারণে সমাজে যে সমালোচনা চলছিল তিনি এ ব্যাপারে চোখ কান খোলা রাখতেন। অনতিবিলম্বে ক্ষেন্তিকে বিয়ে দিতে না পারলে সমাজ তাঁদেরকে যে এক ঘরে করবে তা তিনি জানতেন বলেই ক্ষেন্তির বিয়ের জন্য স্বামীকে উদ্যোগ নিতে তাড়া দিয়েছেন। সমাজ তাঁদেরকে একঘরে করে বসলে এতগুলো মেয়ে নিয়ে তাঁকে যে কি দুর্গতির শিকার হতে হবে সে সম্পর্কেও তিনি সজাগ ছিলেন। তাইতো তাঁকে ক্ষেন্তির বিয়ের ব্যাপারে উদাসীন স্বামীকে তিরস্কার করতে দেখা যায়।
ধৈর্যশীলা অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণা ছিলেন একজন ধৈর্যশীলা ব্রাহ্মণ রমণী। দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনও ধৈর্যচ্যুত হননি। ‘পথের পাঁচালীর’ সর্বজয়ার মতই অন্নপূর্ণা সর্বদা প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। স্বামীর বেলাল্লাপনা ও কন্যাদের জ্বালাতন তিনি আপন কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন, কিন্তু তা উগরে দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করেননি। সর্বংসহা ধরণীর মতো অন্নপূর্ণা সবকিছু সহ্য করেছেন।
শাশ্বত নারী অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণা গ্রামবাংলার সর্বংসহা এক শাশ্বত নারী। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে অন্নপূর্ণার মতো নারীরা বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোকে বুকের ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করে আসছেন। এঁদের ত্যাগ ও ধৈর্যের কারণেই গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার সুখী পরিবার গড়ে উঠেছে। এঁরা নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে পরিবার পরিজনদের সুখী করতে প্রয়াস পান। ‘পুঁইমাচা’ গল্পের সহায়হরি চাটুয্যের স্ত্রী অন্নপূর্ণাও নিজের সুখ-শান্তি, ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে স্বামী ও সন্তানদের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এজন্যই তিনি কিংবদন্তির মতই এক শাশ্বত নারী। এঁরা প্রদীপের মতো পুড়ে পুড়ে অন্যের জন্য আলো বিতরণ করেন; ধূপের মতো দগ্ধীভূত হয়ে গন্ধ ছড়ান। মমতাময়ী অন্নপূর্ণা দারিদ্র্যপীড়িত পিতামাতার ঘরে জন্ম নিয়ে মেয়েগুলো স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতে না পারলেও মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছিল অকাতরে । অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণা ছিলেন একজন মহীয়সী মমতাময়ী মা। আপন সন্তানদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাদেরকে যেমন শাসন করেছেন তেমনি সোহাগেও সিক্ত করে রেখেছেন। মমতার অণু-পরমাণুতে গঠিত ছিল তাঁর দেহ ও মন।
আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তিনি ছিলেন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন রমণী। স্বামী ও মেয়েদের অপরের জিনিস চেয়ে আনাকে তিনি আত্ম-অবমাননাকর বলে মনে করতেন। বরজপোতার জঙ্গল থেকে স্বামীর মেটে আলু তুলে আনাকে তিনি যেমন সমর্থন করেননি, তেমনি মেয়েদেরও পাড়ার রায়দের ফেলে দেয়া পুঁইডাটা কুড়িয়ে আনাকেও তিনি তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মসম্মানবোধের তীব্রতাই প্রকাশ পেয়েছে।
কোমল স্বভাবা অন্নপূর্ণা : অন্নপূর্ণা ছিলেন কোমল স্বভাবা রমণী। মেয়েদের নির্লজ্জতাকে তিনি ভর্ৎসনা করলেও তাঁর ভেতরকার কোমল আত্মাটি তাদের প্রতি সহানুভূতিতে বিচলিত হয়ে উঠেছে। অন্যের কাছ থেকে চেয়ে আনা পুঁইডাটা ফেলে দিলেও পরে আবার তা থেকে কিছু তুলে এনে মেয়েদের রান্না করে খাইয়েছেন। পিঠে তৈরি করার সময় কন্যাদের লোলুপ চোখের ভাষা বুঝতে পেরে তিনি তাদের হাতে ময়দার গোলা ও নারকেল কোরা তুলে দিয়েছেন। তাঁর এই আচরণ থেকে তাঁর কোমল হৃদয়ের পরিচয় যাওয়া যায়।উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অন্নপূর্ণা এক সর্বংসহা ধৈর্যশীলা রমণী। তাঁর সন্তান-বাৎসল্য ও কর্তব্যপরায়ণতা তাঁকে অতুলনীয় জননীতে পরিণত করেছে। তিনি সংসার জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতে পাননি বটে কিন্তু স্বামী-
সন্তানদের সকল প্রকার প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করতে তৎপর ছিলেন। তিনি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী এবং মমতাময়ী মা।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%87%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9a%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%b7/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*