বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থায় বিভিন্ন যুগে নারীদের অবস্থান আলোচনা কর ।

অথবা, বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান আলোচনা কর।
অথবা, বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান বর্ণনা কর।
অথবা, বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থানের বিবরণ দাও।
অথবা, বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থায় বিভিন্ন যুগে নারীদের অবস্থান বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা পেরিয়ে বিশ্বকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় বিভিন্ন যুগ বা পর্যায়ে নারীসমাজের মানবিক মর্যাদা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। তাই ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে নারীর প্রতি বঞ্চনা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা আর শোষণের বিচিত্র ঘটনা। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার মধ্যেও এ বৈষম্য
ও নিগ্রহ হ্রাসতো পায় নি, বরং আরও বেড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থায় চিত্রটি একই রকম ছিল না। আর এ উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রথমে নির্ধারণ করেছে নারীদের। তবে সামাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন,
যে অবস্থান আছে তা সমাজেরই সৃষ্ট নারী ও পুরুষের সমাজ –
Margarat Mead এর ঘোষণা : Margarat Mead নামক একজন সমাজবিজ্ঞানী নারী ও পুরুষের অবস্থান নিয়ে গবেষণা করেন এবং আফ্রিকার তিনটি উপজাতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। সেখানে তিনি দেখতে পান যে প্রথমত, প্রথম উপজাতিতে নারীদের প্রাধান্য বেশি।
দ্বিতীয়ত, উপজাতিদের মাঝে নারী ও পুরুষ উভয়ের অবস্থানটি সমান। অর্থাৎ, দু’জনই সমান অধিকার ভোগ করছে।
তৃতীয়ত, তৃতীয় উপজাতিতে দেখা যায় যে, নারীর তুলনায় পুরুষের অধিকার বেশি।
ফলাফল : অবশেষে Margarat Mead এ ধারণায় উপনীত হন যে, প্রকৃতিগত কারণে নারী ও পুরুষের মাঝে পার্থক্য থাকলেও সামাজিক অবস্থানটি একেবারেই সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত
বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান : যুগে যুগে নারীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জানার জন্য ইতিহাসের কাল পর্বকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হল :
১. সভ্যতার ঊষালগ্ন : সভ্যতার ঊষালগ্নে মহিলাদের অবস্থান এখনকার মত অধস্তন ছিল না। তখন পুরুষ ও মহিলাদের অবস্থানটি ছিল সমান। অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের চেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
২. প্রাগৈতিহাসিক যুগ বা আদিম সাম্যবাদী যুগ : আঠার শতকের সমাজতান্ত্রিক আগস্ট বেবেল তথ্য প্রমাণাদি দিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, “নারীরাই প্রথম মানুষ, যারা প্রথম বশ্যতা ও দাসত্বের বন্ধন স্বীকার করেছিল। নারীরা দাসপ্রথারও আগে দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছে।” এ যুগে মানুষরা ছিল যাযাবর। গোত্র প্রথাই ছিল মানবসমাজের ভিত্তি। এখানে নারীদে উপর দায়িত্ব ছিল অনেক। নারীরা একই সাথে দু’টি কাজ করত। যেমন-
ক.শিশু প্রতিপালন এবং পরিবারের অন্ন সরবরাহ করা।
অন্যদিকে, পুরুষদের দায়িত্ব ছিল পশু শিকার করা। উল্লেখ্য, মেয়েরা অনুকূল গোত্র থেকে স্বামী গ্রহণ করত। সে সময়কে মাতৃ অধিকারের যুগও বলা হয়েছে। এ কালপর্বে ব্যক্তিমালিকানা ও শ্রমবিভাজনের ব্যাপকতা না থাকার দরুন নারী-পুরুষের মধ্যে তেমন কোন লক্ষণীয় পার্থক্য দেখা যায় নি। মার্কস ও এঙ্গেলসের ভাষায় “আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিমালিকানার রূপটির অনুপস্থিতির জন্যই শ্রেণীশোষণ ও নারীর অধস্তন অবস্থা উভয়ই অনুপস্থিত ছিল।”
৩. কৃষি ও পশু পালন যুগ : কৃষি যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে মহিলাদের অবস্থান ছিল অনেক সুদৃঢ় এবং উপরের স্তরে। ইতিহাসে দেখা যায়, মহিলারা কৃষি উৎপাদন উদ্ভাবন করেছিল। এ সময় মহিলারা পুরুষদের সমকক্ষ ছিল। মহিলারা একই সাথে সন্তান প্রতিপালন ও রান্নাবান্নার কাজ করত। কাজের ব্যাপ্তিতে মহিলাদের সিংহভাগ কাজ সম্প্রসারণের জন্য তাদের স্থান ছিল অনেক উপরে। কিন্তু কালক্রমে লাঙ্গলের প্রচলন ঘটল। আর কুমারের চাকার প্রচলন ঘটল। এসব যন্ত্র ভারী হওয়ার কারণে এগুল পুরুষরা পরিচালনা করত। তাই ধীরে ধীরে সমাজে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। কাজেই কথায় আছ “বিজ্ঞান নারীদের জীবনযাত্রাকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে দিয়েছে, কিন্তু পরিণামে কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ আসনটি।” বস্তুত এভাবেই মহিলাদের অবস্থান ক্রমান্বয়ে নিচে নামতে থাকে।
৪. দাস যুগ : কালক্রমে আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানা ও শ্রম বিভাজন দেখা দেয়। যার দরুন আদিম সাম্যব্যবস্থা ভেঙ্গে শোষণমূলক সমাজে দাস ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। এ ব্যবস্থায় শ্রেণী শোষণ ও ব্যক্তিমালিকানার রূপটি বিকশিত হতে থাকে। দাস ও মালিকদের মধ্যে এ শোষণ চলতে থাকে। এদিকে নারীর পাশাপাশি
পুরুষরাও শোষণের শিকারে পরিণত হয়। দাস যুগে নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। ব্যাপক নারী নির্যাতনের মধ্যদিয়েই দাস ব্যবস্থা অগ্রসর হতে থাকে। এ যুগে কোন নবজাত কন্যা সন্তানকে প্রায়ই মেরে ফেলা হতো। এ নিষ্ঠুর পৈশাচিক পদ্ধতিতে শিশুকন্যা হত্যার
্পাশাশাপাশি অন্যগোত্র থেকে নারীকে বলপূর্বক হরণ করে আনারও রেওয়াজ ছিল। খাদ্য সংকটের কারণে এ যুগে মেয়ে সন্তানকে মেরে ফেলা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। মোটকথা পুরুষের উপর নির্ভরশীল নারী সামাজিকভাবে বসবাস করত। ইতিহাসের এ নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ে নারীরা পুরুষের ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
৫. সামন্ততান্ত্রিক যুগ : একে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলে সামাজিক স্তরবিন্যাস (Social Stratification)। এ যুগে নারীদের অবস্থা আরও বেশি করুণ ছিল এবং ধর্মের প্রাধান্য ছিল বেশি। রেনেসাঁ ছিল ধর্মের বিরুদ্ধে বিজয়। দেবতা বা ভগবান ছিল ক্ষমতার আঁধার এ যুগে মানুষকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। রাজা, ভূস্বামী এবং দাস। সামন্ত যুগে রাষ্ট্র তথা সমাজ ছিল পুরুষকেন্দ্রিক। এ সমাজে প্রথমে ছিলেন রাজা, তারপর ভূস্বামী সবার নিচে দাস। ভূস্বামীরা তাদের জমি চাষ করাতেন দাসদের দিয়ে। দাস এবং জমি এ যুগে পুরুষদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল এবং স্ত্রী ও সন্তানরাও তাদের সম্পত্তি ছিল। সবকিছু পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় পরিবারের কর্তা ছিলেন পুরুষ। আর সমাজে মহিলাদের অবস্থানটি ছিল চরম অবমাননাকর। অর্থাৎ, তারা ছিল একেবারেই পুরুষের অধস্তন।
৬.পুঁজিবাদী যুগ : সামন্তযুগের অবসানের পর পুঁজিবাদের যুগ শুরু হয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের (Frenc Revolution) মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। মহিলারা আশা করেছিলেন পুঁজিবাদের যুগে তাদের অবস্থান হয়তোবা কিছুটা উন্নত হবে। কিন্তু দেখা গেল পুঁজিবাদে মহিলারা আরও নির্মম পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হল। পুঁজিবাদের যুগে দেখা যায়, নারীদের প্রায় প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপনের কাজে লাগানো হয় এবং বিপণনের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের মাতৃত্বের অধিকার ও আইনগত অধিকার দিতে রাজি হয় না। পেশার ক্ষেত্রেও নারীরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়।অতএব দেখা যায় যে, পুঁজিবাদ আবির্ভাবের পর পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা ও অবদমিত অবস্থা আরও তীব্র হয়। এ যুগে মহিলাদের কোন নিরাপত্তা ছিল না ‘The German Idology’ তে বিধৃত নারীর অবস্থার বস্তুগত ব্যাখ্যার মূল ভাবটি আরও বিকশিত হয় Angels রচিত “The Origin of the Family, Private Property and the State.” বইটিতে। তাঁর ধারণা একগামী বিবাহে ফলে সৃষ্ট নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বকে লিঙ্গীয় সম্পর্কভিত্তিক নয়, শ্রেণীদ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছেন। পরিবারে পুরুষরা বুর্জোয়া আ নারীরা প্রলেতারিয়েতের প্রতিনিধিত্ব করে। [Source : Angels, The Origin of the Famil page – 83]
৭. সমাজতন্ত্রে মহিলাদের অবস্থান : সমাজতন্ত্রে অন্যান্য যে কোন সময়ের তুলনায় নারীর অবস্থান অনেকটা শুভকর। এ যুগে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা হয় এবং বলা হয়েছে যে, উৎপাদনে পুরুষের মতোই নারীর সমান অংশীদারিত্ব থাকবে এবং উৎপাদনের মালিকানা রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
ক.নারী যে কোন পেশায় পুরুষদের সাথে যোগদান করতে পারবে।
খ.সমাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি ছিল সবাই শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। কাজেই পেশাগত জীবনে মহিলাদের কোনপ্রকার পার্থক্য হবে না।
গ. মহিলারা তাদের বিয়ে করার ও মাতৃত্বের অধিকার লাভ করতে পারবে। সমাজতন্ত্রে বলা হয় মহিলাদেরকে বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে না।
এসব মৌলিক কারণে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী অনেক বেশি স্বাধীন ও স্বনির্ভর। তাই দেখা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নে পুরুষের তুলনায় মহিলারা চিকিৎসা পেশায় বেশি ছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদ খুব কম দেশেই যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার জন্য সমাজতন্ত্রবাদ সোভিয়েত ইউনিয়নে এ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
৮. বিশ্বায়ন যুগ বা বর্তমান যুগ : বর্তমান যুগে নারীদের অবস্থান সুদূর প্রসারী। ঘরে ও বাইরে তারা আজ কর্মমুখর জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া সংসারের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব নারীকেই পালন করতে হয় বলে সেখানেও তার অবদান অসামান্য। শিশুর চরিত্র গঠনেও মায়ের ভূমিকা অনেক। তাছাড়া পারিবারিক জীবনের সুখশান্তি পুরুষদের জীবন সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। আর সুন্দর জীবনের অধিকারী পুরুষরাই পারে জাতীয় জীবনের উন্নতির পথ প্রশস্ততর করতে, পারিবারিক জীবনে সুখশান্তি বজায় রাখার মাধ্যমে নারীসমাজ জাতি গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাইরের জগতেও নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জ্ঞানার্জন থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা আজ নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। ফলে জীবনের বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে তারা পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে চলছে। জ্ঞান, বুদ্ধি প্রয়াসে নারীরা কর্মক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে নিজেদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। এ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, কাজেই বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, নারী সেদিনই পরিপূর্ণ মুক্তিলাভ করে পুরুষের পাশাপাশি সমঅধিকারের ভিত্তিতে অবস্থান করতে সক্ষম হবে, যেদিন ব্যক্তিমালিকানা ও পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামোর বিন্যাস ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানার সূচনা ঘটবে। Engels বলেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়ে গেলে নারী-পুরুষের মধ্যে দাসীর সম্পর্ক থাকবে না। তখন তাদের সম্পর্ক নিছক নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এমন একটি সাম্যবাদী সমাজই অদূর ভবিষ্যতে নারীমুক্তি অনিবার্য করে তুলবে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*