বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নব্যপন্থিদের মতামত সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা আলোচনা কর।

অথবা, শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষার সংস্কার সম্বন্ধে যে মতামত ব্যক্ত করেছেন সে বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা কর।
অথবা, ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে তিন রকমের বাংলা শব্দ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মতামত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলা গদ্যের উন্মেষ পর্বে সাহিত্যে ভাষা ব্যবহার নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এ উভয় শ্রেণির মতামত বিশ্লেষণ করে বাংলা গদ্যের আদর্শরীতি সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন। ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বাংলা গদ্য রচনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা উচিত তা বিস্তৃত করে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণিত তিন রকমের বাংলা শব্দ সম্পর্কে তিনি তাঁর মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেছেন। সুশিক্ষিত নব্য সম্প্রদায়ের মুখপাত্র শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষা বিষয়ে সুসঙ্গত ও গ্রহণীয় কিছু অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি কিছু অতিরঞ্জিত বক্তব্য দ্বারা গ্রহণযোগ্যতার সীমা অতিক্রম করেছেন।
শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অতিরঞ্জিত অভিমত :
১. বহুবচন নির্দেশে ‘গণ’ শব্দ ব্যবহারে তিনি অসম্মত।
২. বাংলা ভাষায় লিঙ্গভেদ তিনি মানেন না। ‘পৃথিবী’ যে বাংলা স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ এটা তাঁর অসহ্য।
৩. বাংলা ভাষায় সন্ধি তাঁর চক্ষুশূল। ‘জনৈক’ লিখতে তাঁর ঘোর আপত্তি।
৪. ত্ব-প্রত্যয়ান্ত এবং গ-প্রত্যয়ান্ত শব্দ ব্যবহারের তিনি সম্পূর্ণ বিরোধী।
৫. সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দ যেমন- একাদশ বা চত্তারিংশত ইত্যাদি ব্যবহার বাংলায় বর্জনীয়।
৬. সংস্কৃত শব্দ ভ্রাতা, কল্য, কর্ণ, তাম্র, স্বর্ণ, পাত্র, মস্তক, অশ্ব ইত্যাদি বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা যাবে না। শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ভাষার ওপর এরূপ অনেক দৌরাত্ম্য প্রদর্শন করলেও পাশাপাশি বাংলা ভাষা সম্বন্ধে তাঁর সারগর্ভ বক্তব্য স্মরণযোগ্য।
৭. পাতা, মাথা, ঘোড়া প্রভৃতির ক্ষেত্রে কেবল সংস্কৃত থেকে রূপান্তরিত শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
বাংলা শব্দ সম্পর্কে শ্যামাচরণ বাবুর বক্তব্য : শ্যামাচরণ বাবু বলেছেন এবং সকলেই জানেন যে বাংলা শব্দ তিন রকমের। যথা :
প্রথমত, সংস্কৃতমূলক শব্দ; যার বাংলায় রূপান্তর ঘটেছে। যেমন- ‘গৃহ’ থেকে ‘ঘর’, ‘ভ্রাতা’ থেকে ‘ডাই’।
দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতমূলক শব্দ; যার বাংলায় রূপান্তর ঘটেনি। যেমন- জল, মেঘ, সূর্য ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, যে সব শব্দের সংস্কৃতের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যেমন- ঢেঁকি, কুলা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি।
প্রথম শ্রেণির শব্দ সম্পর্কে শ্যামাচরণ বাবুর মত হলো রূপান্তরিত সংস্কৃত শব্দ ঘর, ভাই, পাতা, তামা, সোনা প্রভৃতি বাংলায় ব্যবহার করতে হবে। এর পরিবর্তে গৃহ, ভ্রাতা, তাম্র, স্বর্ণ এগুলো একেবারেই ব্যবহার করা যাবে না।
দ্বিতীয় শ্রেণির শব্দ যেমন জল, মেঘ, সূর্য প্রভৃতির ব্যাপারে তাঁর কিছু বলার নেই।
তৃতীয় শ্রেণির শব্দ অর্থাৎ যেসব শব্দের সাথে সংস্কৃতের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি সেগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী।
বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্লেষণ : শ্যামাচরণ বাবুর এ অভিমতকে বঙ্কিমচন্দ্র যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে রূপান্তরিত প্রচলিত সংস্কৃতমূলক শব্দের পরিবর্তে কোন স্থানেই অরূপান্তরিত মূল সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা যাবে না একথা ঠিক নয়। কেননা ‘মাথা’ শব্দটিও যেমন প্রচলিত ‘মস্তক’ শব্দটিও তেমনি প্রচলিত। যেখানে ‘মাথা’ লিখলে ভালো শোনায় সেখানে ‘মাথা’ লেখা উচিত এবং যেখানে ‘মস্তক’ লিখলে ভালো শোনায় সেখানে মস্তক লেখা বাঞ্ছনীয়। মাতা, পিতা, ভ্রাতা, গৃহ, মস্তক প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষা থেকে বহিষ্কার করা সম্ভব নয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্লেষণ : ‘ঘর’ শব্দটি প্রচলিত আছে বলে ‘গৃহ’ শব্দের উচ্ছেদ যেমন অপ্রয়োজনীয় তেমনি ‘মাথা’ শব্দ প্রচলিত আছে বলে ‘মস্তক’ শব্দ বর্জন বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু অকারণে ‘ঘর’ শব্দের পরিবর্তে ‘গৃহ’ এবং ‘মাথা’ শব্দের পরিবর্তে ‘মস্তক’ শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয়। বাংলা লিখতে গিয়ে অকারণে বাংলা ছেড়ে সংস্কৃতের দ্বারস্থ হওয়া ঠিক নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতের বদলে বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে ভাষা তেজস্বী হয়। ‘হে ভ্রাতঃ’ বলে ডাকলে ভাই হয়তো বুঝতে না পেরে সাড়াই দেবে না। কিন্তু ‘ভাইরে’ বলে ডাক দিলে ভাইয়ের মন ব্যাকুল হতে বাধ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্লেষণ হলো যে যে ক্ষেত্রে যে শব্দ অধিকতর আবেদনময় সে ক্ষেত্রে সে শব্দই ব্যবহার করা উচিত।
বঙ্কিমচন্দ্রের মতামত: দ্বিতীয় শ্রেণির শব্দ অর্থাৎ যেসব সংস্কৃত শব্দ রূপান্তরিত না হয়েই বাংলায় প্রচলিত আছে তাদের সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু বলার নেই সেগুলো প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করা বিধেয়। আর তৃতীয় শ্রেণির শব্দ অর্থাৎ যেসব শব্দের সংস্কৃতের সাথে কোন সম্পর্ক নেই সেসব শব্দ সম্পর্কে শ্যামাচরণ বাবু যা বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র তা অনুমোদন করেছেন। ঢেঁকি, কুলা, স্কুল, কলেজ, নুন এসব শব্দ প্রাচীনপন্থিরা বাতিল করে দিয়েছেন আর নব্যপন্থিরা এদেরকে বাংলা ভাষার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ সকল অসংস্কৃত শব্দ বর্জনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচীনপন্থিদের মূর্খ বলে কটূক্তি করেছেন এবং নব্যপন্থিদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাঁর মত হলো, “বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে- যতটুকু বলিবার আছে, সবটুকু বলিবে- তজ্জন্য ইংরেজি, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য- যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে। অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, তিন ধরনের বাংলা শব্দ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও মতামত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষাকে সহজ, সরল, সুন্দর ও স্পষ্ট করে লেখার জন্য তিনি কথিত তিন রকমের শব্দই ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণ করার পক্ষপাতী। কোন শব্দের প্রতিই তার দুর্বলতা বা বিদ্বেষ নেই। ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ মতামত জ্ঞাপন করেছেন। তাঁর এসব অভিমত বাংলা ভাষার লেখকদের অবশ্যই অনুসরণযোগ্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b7%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%ac%e0%a6%99/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*