বাঙালি দর্শন বলতে কী বুঝায়? বাঙালি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।

অথবা, বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা দাও। বাঙালি দর্শনের কোনো প্রয়োজন আছে কি?
অথবা, বাঙালি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা প্রদানপূর্বক এর আবশ্যকতা আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের পরিচয় দাও। বাঙালি দর্শনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব, অজানাকে জানার একটা প্রবল ইচ্ছা তার মধ্যে বিদ্যমান। সে জানতে চায় মানুষের আত্মার স্বরূপ কি, আত্মা অমর কি না, জগতের মূল কি, জগৎ কে সৃষ্টি করল ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষ নিবিষ্টচিত্তে চিন্তা করে। মানুষের এ চিন্তাই দর্শন। তাই বলা যায়, দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত কিছু মৌলিক বিষয়ের যৌক্তিক আলোচনা। দর্শনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে একটি অন্যতম শাখা হলো বাঙালি দর্শন।
বাঙালি দর্শন : ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অন্যান্য প্রাগ্রসর জাতির মত বাঙালির দর্শন চিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির ধ্যানধারণা, চিন্তা-মনন, ভাবধারা, মতামত, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ। বাঙালি দর্শন নিছক দুঃখবাদী কিংবা ভাববিলাসী দর্শন নয়, বাঙালি দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত দর্শন। তাই বলা যায়, বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় রূপ ও রসের মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে মরমি চেতনায় উদ্ভূত যে দর্শন জন্মলাভ করেছে, তাকেই বাঙালি দর্শন নামে অভিহিত করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা আলোচনা করা হলো :
বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার রায় বলেছেন, “যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাঙালি দর্শন।”
অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, “বাঙালি দর্শন মুক্তি বা মোক্ষলাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।”
অধ্যাপক সাইদুর রহমান দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, “বাঙালি দর্শ কেবল সমদর্শন নয়, খালি পরলোকচর্চা তত্ত্ববিদ্যার নিছক রোমন্থন ও কসরত নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের যে কোনো সার্থক দর্শনের ন্যায় বাঙালি দর্শনও মূলত জীবনদর্শন, উন্নত মানবজীবন প্রণয়ন ও যাপনের উপায়ানুসন্ধান।”
সুতরাং উপরের আলোচনা হতে বলা যায় যে, বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তাচেতনা, মনন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচিত জীবনদর্শন।
বাঙালি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা : প্রাক ঐতিহাসিককাল থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাংলায় বিভিন্ন চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটেছে এবং যুগে যুগে তার দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সমাজকাঠামো তথা জাতির উন্নয়নে দর্শনের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে বাঙালি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. যুক্তিবাদী মানস গঠন : বাংলাদেশের দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একটি বিষয়ে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ ও সমকালীন বাঙালি দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় আর তা হলো এখানকার সব দর্শনেই যুক্তবাদিতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের মননশীলতায় যুক্তিবাদিতা যোগ করে মানুষকে উন্নত স্তরে পৌঁছে দিতে এ দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. মানবতাবাদের জয়গান : প্রাচীন বৈদিক দর্শন, মধ্যযুগীয় বাউল, সুফি ও বৈষ্ণব দর্শন ছাড়াও সমকালীন অনেক দার্শনিক চিন্তায় মানবতাবাদী চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে এ দর্শন বিশেষ অবদান রেখেছে।
৩. জাতি বিদ্বেষ লোপ : প্রাচীন হিন্দুতন্ত্র, বৌদ্ধতন্ত্র, শাক্ত মতবাদ, শৈব মতবাদ মধ্যযুগের বাউল, সুফি ও বৈষ্ণব দর্শন ও জাতিভেদ, বর্ণভেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আবার আধুনিক ও সমকালীন দার্শনিকবৃন্দও এগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম, গোবিন্দচন্দ্র দেব প্রমুখ দার্শনিক এসবের বিপক্ষে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
৪. কুসংস্কার দূরীকরণ : বাঙালি দর্শ নর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিবাদিতা ও বিশ্লেষণী চিন্তাচেতনা।যুক্তিবাদিতা ও বিশ্লেষণধর্মী মনন যেখানে বিরাজ করে কুসংস্কার সেখানে বাসা বাঁধতে পারে না। বাঙালির সুন্দর মানস গঠনে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য বাঙালি দর্শন বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
৫. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা : বাঙালি দর্শনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার অধিকাংশ দার্শনিক মতামত নিৰ্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায় বা জাতির কল্যাণে উপস্থাপিত হয় নি।এখানে যে দর্শন প্রচারিত হয়েছে তাতে অনেক সময় বাঙালিকে অতিক্রম করে বিশ্ব মানবতার কথা বলা হয়েছে।এভাবে বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও বাঙালি দর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৬. মুক্তবুদ্ধি প্রতিষ্ঠা : বাঙালির দার্শনিক ধারাসমূহকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেখানে ভাববাদ, জড়বাদ,ভাববাদ ও জড়বাদের সমন্বয়, আস্তিক্যবাদ, নাস্তিক্যবাদ, মানবতাবাদ বিশ্বশান্তি মতবাদ প্রভৃতি বিষয় আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এগুলো মানুষের মুক্তচিন্তার গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে যা মানুষকে উন্নত ভাবাদর্শের দিকে নিয়ে যায়। এভাবে ব্যক্তির উন্নতি, জাতির উন্নতি ও রাষ্ট্রের উন্নতিতে এদেশের দর্শন অত্যন্ত কার্যকররূপে প্রতিভাত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, এখানে একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক, পরলোকমুখী বা পরাতাত্ত্বিক বিষয়ের আলোচনা স্থান পেয়েছে, অন্যদিকে বাস্তববাদী চিন্তাধারাও আলোচনায় এসেছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে বাঙালি দর্শনে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাই এ দর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হিসেবে আমাদের কাছে অনুভূত হয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*