বাঙালি দর্শনে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কিভাবে বাঙালি দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে তা বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনাই দর্শন। দর্শনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে অন্যতম হলো বাঙালি দর্শন। বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির ধ্যানধারণা, চিন্তন-মনন, ভাবধারা, মতামত, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতির সংমিশ্রণ। বাঙালি দর্শন শুধু আবেগাত্মক বা বিলাসী নয়, বাঙালি দর্শন হলো বিচারবুদ্ধি ও বিচক্ষণতার দর্শন।বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন প্রভাব বিস্তারকারী উৎসের মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অন্যতম।
বাঙালি দর্শনে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের অবদান বা প্রভাব : নিম্নে বাঙালি দর্শনে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের অবদান আলোচনা করা হলো:
১. মানুষের স্বরূপ : মনুসংহিতার মত কৌটিল্যও মানবসমাজকে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এ চার ভাগে ভাগ করেছেন। তবে জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণদের অধিকার সম্পর্কে মনু ও কৌটিল্যের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। কৌটিল্য মানবজীবনকে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এ চার ভাগে ভাগ করেছেন।
২. আশ্রম করণীয় : প্রতিটি আশ্রমে মানুষের কি করণীয় আর বর্জনীয় তা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে নির্ধারিত হয়েছে। পরিবারের ভরণপোষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ কৌটিল্য সমর্থন করেন না। কারণ এতে সন্ন্যাসী পরিবারের সদস্যের নৈতিক স্খলন ঘটতে পারে। কৌটিল্য গৃহস্থকে সমাজের মধ্যমণি বলে মনে করেছেন এবং গার্হস্থ্যাশ্রমকে সকল আশ্রমের প্রাণকেন্দ্ররূপে চিহ্নিত করেছেন। মনুর মত কৌটিল্যও অষ্টবিদ বিবাহ রীতি সমর্থন করেছেন। তাই পরিবারের ভরণপোষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে যদি কেউ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন, তাহলে কৌটিল্য ঐ ব্যক্তির শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেছেন তাঁর শাস্ত্রে।
৩. সকল আশ্রমের প্রাণকেন্দ্র গার্হস্থ্যাশ্রম : মনুসংহিতার মত কৌটিল্যও সকল আশ্রমের প্রাণকেন্দ্ররূপে গার্হস্থ্যাশ্রমকে
চিহ্নিত করেছেন। কৌটিল্যের মতে, “গৃহস্থই সকলের আশ্রয়স্থল ও আশাভরসার প্রতীক।”
৪. নারী জাতিরা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিতা : নারী জাতির উন্নয়নের কথা মনুসংহিতার মত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও দেখা যায়। এখানেও নারীরা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিতা। কৌটিল্য শুধুমাত্র নারী জাতিকে উচ্চাসনে বসান নি, তিনি মানুষকে হেয় করা বা মানব মর্যাদার পক্ষে হানিকর কোনো বিধানও স্বীকার করেন নি।
৫. দাসপ্রথা সম্পর্কে কৌটিল্য : অর্থশাস্ত্রে দাসপ্রথার কোনো উল্লেখ নেই। প্রতীচ্যের গ্রিক লেখকরা তাই স্পষ্টই বলেছেন যে, ভারতবর্ষে মৌর্যযুগে দাসপ্রথা সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত ছিল। প্রতীচ্যে যেমন কিছু কিছু লোক জন্মগতভাবে দাস বলে পরিচিত ছিল, ভারতবর্ষে এ রকম তখন কিছু ছিল না। ভারতবর্ষে দাস সম্প্রদায় বলতে বুঝায় তাদের, যারা সমাজের সেবক। এদেরকে অর্ধ দাস বলে আখ্যায়িত করা যায়। গ্রিক দাসদের মত এরা ধিকারবিহীন ছিল না। টিল্য সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, একজন আর্যকে কোনো অবস্থাতেই অন্যের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যায় না, অন্তত ভারতবর্ষ তা স্বীকার করে না। তবে অপরাধের শাস্তি ভোগ করার জন্য আর্য সন্তানদের বিক্রয়ের ব্যবস্থা সে যুগে ছিল। আর্থিক দুরবস্থাসম্পন্ন একজন প্রাপ্তবয়স্ক তাঁর আর্থিক উন্নতির জন্য স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করতে পারলেও উত্তরকালে ঋণ পরিশোধ করে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিধানও কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রেখেছেন।
৬. রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনা : কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রের একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়ে রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনা করেছেন।তিনি ছিলেন রাজতন্ত্রের একজন একনিষ্ঠ সাধক। তাই অরাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। কিভাবে অরাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদেরকে রাজতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়, এ ছিল তাঁর রাজনৈতিক সমীক্ষার সকল প্রশ্নের বড় প্রশ্ন। চতুর্দশ লুই এর আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পূর্বেই কৌটিল্য উক্ত নৃপতির মত সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, রাজাই রাষ্ট্র।
৭. রাষ্ট্রের উৎপত্তি : রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে কৌটিল্য সরাসরি কিছু না বললেও পরোক্ষভাবে প্রচলিত মতকেই সমর্থন করেন। প্রচলিত মতে, মানবসমাজ যখন মৎস্যধর্মে বিভক্ত হয়ে বৈবস্তুত মনুর কাছে গিয়ে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করল, তখন তিনি তাদের রাজা হয়ে এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেন। শর্ত থাকে যে, এজন্য তিনি প্রজাদের ফসলের ছ’ভাগের একভাগ এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের দশভাগের একভাগ প্রাপ্য হবেন। এ থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি।
৮. রাজার গুণাবলি : কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে রাজার উপর। রাজারা যদি সদগুণ ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হন, তবে রাজ্যের মঙ্গল ও শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়। তাঁর মতে, যিনি রাজা হবেন, সিংহাসনে আরোহণ করার পূর্বেই তাঁকে বিদ্যার্জনের মহৎগুণের অধিকারী হতে হবে। সিংহাসনে আসীন হওয়ার আগেই কিভাবে রাজা বিদ্যার্জন ও শিক্ষা লাভ করবেন, সিংহাসনে আরোহণ করার পর কিভাবে তিনি তা প্রয়োগ করবেন এবং কিভাবে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কর্ম ও প্রজাদের প্রতি কর্তব্য পালনে সময় ও মনোযোগ বণ্টন করবেন, সে সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে কৌটিল্য আলোচনা করেছেন।
৯. রাজা মনোনীত : কৌটিল্য মনে করেন যে, তাঁকেই রাষ্ট্রের রাজা মনোনীত করা উচিত, যিনি সর্বদাই প্রজাদের ল্যাণার্থে মনোযোগী থাকবেন। তাঁর দান ধনী-নির্ধন, সাদা-কালো, সুন্দর কুৎসিত, নারী-পুরুষ এককথায় আবালবৃদ্ধ বনিতার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আদর্শ রাজা প্রজাদের সমস্যা অন্তরে ধারণ করে এর দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করেন।
১০. রাষ্ট্রের শাসননীতি : কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে শাসননীতি, বিভিন্ন পদের মন্ত্রী নির্বাচন, দেশের বৈষয়িক উন্নতি, শুদ্ধনীতি, সেনাদলের নিয়মানুবর্তিতা এবং নৈতিকতার লালন ও অনুশীলনের ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।তাঁর মতে, আদর্শ রাজার একটি লক্ষণ হচ্ছে তাঁর নতুন দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকা। কৌটিল্য যুদ্ধকে শেষ উপায়রূপে ব্যবহার করার জন্য রাজাদের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনায় কৌটিল্যের অবদান অতুলনীয়। সে সুপ্রাচীন যুগে মানুষের কল্যাণের মানবিক আদর্শের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক ও সামাজিক মননের পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা কেবল তিনি নিজেই। তাঁর জন্য ভারতবাসী আজও গর্বিত। কৌটিল্যের চিন্তাধারার মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষের সার্বিক কল্যাণ। আর তাঁর এ প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ চিন্তাচেতনা বাঙালি দর্শনের দার্শনিকদের চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*