বাউল শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, বাউল শব্দের উৎপত্তি নিরূপণ কর।
অথবা, বাউল শব্দের উদ্ভব কীভাবে?
অথবা, বাউল শব্দটি কোন শব্দ হতে এসেছে?
অথবা, বাউল শব্দের উৎস সম্পর্কে লিখ।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাউল বাংলার একটি লোকজ সম্প্রদায়। বাউল সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণত নিম্নবর্ণের।জীবনাচারে বাউলরা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং সমাজের স্বাভাবিক স্রোতধারা থেকে স্বতন্ত্র । পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন আচার-ব্যবহার, ধর্মবিশ্বাস, কর্মসাধনা ইত্যাদি দিক দিয়ে যারা সমাজে বসবাসকারী অন্যান্যের চেয়ে স্বতন্ত্র, যারা আপনভাবে মশগুল ও উন্মাদ তাঁরাই আমাদের নিকট ‘বাউল’ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে ‘বাউল’ নামটি আমাদের নিকট অতি সুপরিচিত হলেও ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নির্ণয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই।
বাউল শব্দের উৎপত্তি : বাউল মতের উৎস ও উৎপত্তি কাল নিয়ে যেমন তেমনি ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নিয়েও বাউল গবেষক, উপাসক, সাধক ওপণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ও ভারতের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁদের স্ব-স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎস নিরূপণে সচেষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদের মতের পক্ষে নানা যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। কেউ বলেন ‘বাউর’ অর্থাৎ এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল শব্দ থেকেই বাউল নামের উদ্ভব হয়েছে। কারো মতে, বাউল মতের উদ্ভবকালে দীন-দুঃখী লোক একতারা বাজিয়ে গান করতো বলে তাদের ‘বাতুল’ বলা হতো। এই ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল নামের উদ্ভব। প্রাকৃত ‘বাউর’ শব্দের ‘র’ স্থলে ‘ল’ হয়ে ‘বাউল’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। অনেক চিন্তাবিদের মতে, সংস্কৃত ‘বাতুল’ (উন্মাদ) শব্দের প্রাকৃতরূপ ‘বাউর’ ও ‘বাতুল’ এবং হিন্দি শব্দ ‘বাউরার’ (পাগল, ক্ষ্যাপা) থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এ মতে বাউল শব্দের মূল বাতুল অর্থাৎ উন্মাদ কি ভাবোন্মাদ অর্থ হতে পরবর্তীকালে একটি বিশিষ্টভাবের নিরন্তন আবেগে বাহ্যজ্ঞানশূন্য, ধর্মোন্মাদ, উদাসীন, পাগল, ক্ষ্যাপা, আত্মকর্ম সমাহিত সাধকদের আবির্ভাব ঘটে যাঁদের বাউল বলা হয়। বাউল গানে ‘পাগল’ ও ‘ক্ষ্যাপা’ শব্দ দুটির ব্যবহার লক্ষ করা গেলে ও ‘বাতুল’ শব্দের ব্যবহার নেই। সাধারণ লোকও বাউলকে বাতুল বলে না। কেননা ‘বাতুল’ বলতে পাগল বা উন্মাদ শ্রেণিকে বুঝায়,সাধককে বুঝায় না, বাউলরা পাগল, সংসার বিরাগী, উদাসী সত্য, তবে তাঁরা ভাবের বা প্রেমের পাগল, কোনো অবস্থাতেই তাঁরা মস্তিষ্ক বিকৃতিজনিত পাগল নয়। তাই তাদের ‘বাতুল’ অর্থে উন্মাদ বা পাগলের সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। কোনো কোনো বাউল সাহিত্যিক, গবেষক, পণ্ডিত, আকুল, ‘ব্যাকুল’ ‘বাতুল’ শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নির্দেশ করেন। ড. এম লুৎফর রহমান অবহট্ট ও চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত ‘বাজিল’, ‘বাজুল’, ‘বাজির’, ‘বাজ্জিল’ শব্দগুলোকে বাউল শব্দের পূর্বরূপ বলে নির্দেশ করেন। তার মতে, বজী, বজ্জির, বাজির হতে বজ্জিল, বাজিল, বাজুল ও বাউল । আবার ড. আহমদ শরীফ বাউল শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে উপর্যুক্ত দুটি মত অর্থাৎ ‘আকুল’, ‘ব্যাকুল’, ‘বাতুল’ থেকে এবং ড. লুৎফর রহমানের মতকে সমর্থন করে। উপরন্তু বজ্রবাণী সম্প্রদায়ের ‘বজ্রকুল’ শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি বলে স্বীয় মত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, বজ্রবাণী বৌদ্ধ যদি ‘বজ্ৰকুল’ নামে অভিহিত বলে অনুমান করা সম্ভব হয় তবে ‘বজ্রকুল’ হতে বাউল হওয়া আরো সহজ। যেমন- বজ্রকুল, বজ্জউল, বাজুল ও বাউল । কিন্তু ড. আনোয়ারুল করীম বাউল শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে ড. লুৎফর রহমান ও ড. আহম্মদ শরীফ উভয়ের মতকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মনে করেন, চর্যাগীতি বা বজ্রগীতিকার সাথে বাউল গীতিকার সাদৃশ্য হয়তো আছে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ‘বাজিল’ বা ‘বজ্ৰকুল’ শব্দ থেকেই বাউল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি ‘আউলিয়া’ শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি নির্দেশ করেন। তাঁর মতে, আউলিয়া শব্দের অপভ্রংশে আউল এবং পরে অনুকার অব্যয় সংযোগে বাউল শব্দের উদ্ভব। এক্ষেত্রে তিনি ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল, ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রমুখের বরাত দেন। যেমন— ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলেন ‘আউয়াল’ শব্দ থেকে আউল ও তা থেকে বাউল শব্দের উদ্ভব।আবার অনেক বাউল গবেষক ও সাহিত্যিকের মতে, বাউল শব্দটি বাংলা ‘আউল’ শব্দের পৌনঃপুনিক অপভ্রংশ। বাংলা ভাত-টাত, মাছ-টাছ, পাগল-ছাগল ইত্যাদি পৌনঃপুনিক শব্দের মতো ‘আউল’ শব্দের অপভ্রংশ থেকে বাউল শব্দের উদ্ভব। আবার অনেকে ‘বায়ু’ শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নিরূপণ করতে চান। অনেক বাউলদের ‘দম’ সাধনাই তাদের এরূপ ভাবনার কারণ । কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ দুটি মত থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নিরূপণ করা যায় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি ও উৎস নিয়ে পণ্ডিত গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কোনো একক শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এ নিয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। যেহেতু বাউল মতের একক কোনো উৎস নির্ণয় সম্ভব হয়নি তাই কারো মতকেই গুরুত্বহীন বলে বর্জন করা সমীচীন হবে না। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ করলে দেখা যায় ‘বাউল’ শব্দটি বাউল সম্প্রদায়ের নিজেদের দেয়া নয়, বাংলার একশ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, উদাসী, সংসার বিরাগী, প্রেমের পাগল, ক্ষ্যাপা, আপনহারা,আত্মভোলা, ব্যতিক্রমধর্মী জীবনযাত্রার অনুসারী মরমি সাধককে সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা বাউল, বাতুল, বাউরা, ক্ষ্যাপা ইত্যাদি কোনো না কোনো একটি নামে অভিহিত করেন। আর এ থেকেই কালক্রমে বাউল নামের উদ্ভব ঘটে।