বাউল দর্শনে লোকায়ত দর্শনের প্রভাব নিরূপণ কর।
অথবা, বাউল দর্শন লোকায়ত দর্শন দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয় আলোচনা কর।
অথবা, বাউল দর্শনে লোকায়ত দর্শনের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনে লোকায়ত প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, লোকায়ত দর্শন দ্বারা বাউল দর্শন কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাউল মত বাংলার দর্শন, বাঙালির দর্শন, বাঙালির নিজস্ব চিন্তাধারা ও মননের ফসল। বাঙালির নিজস্ব জীবনচেতনা, ধ্যানধারণা ও মনন বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে বাংলার উর্বরভূমিতে উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছে বাউল মত আর এ উদ্ভব ও বিকাশের পথে বাউল মত তার প্রয়োজন অনুযায়ী নানা দার্শনিক মত ও পথের তত্ত্ব গ্রহণ ও বর্জন করেছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে বাউল মত কোনো দর্শনের ছায়াতলে নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়নি। বাউল মতের
উপর প্রভাব বিস্তারকারী তেমনি একটি দার্শনিক স্কুল হলো লোকায়ত দৰ্শন।
বাউল দর্শন : বাউল দর্শন বাংলার নিজস্ব আবহে বিকশিত একটি মরমি আদর্শিক চিন্তাধারা যা কিছু গুহ্য যোগ ক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, সংসার বিরাগী, উদাসী, প্রেম উন্মাদ, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকদের আত্মোপলব্ধিমূলক চিন্তাধারার নাম বাউল দর্শন। বাউলরা জগৎ সংসারকে উপেক্ষা করে আধ্যাত্মিক ধ্যানে মগ্ন থাকেন এবং সামাজিক আচার – অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে চলেন। বাউলদের জীবনদর্শন বাস্তব জীবনমুখীন ও ইহজগৎকেন্দ্রিক, মানুষ এবং মানবতাই বাউলদের সাধন ক্রিয়ার মূল লক্ষ্য বস্তু। মানব দেহকেই বাউল দর্শনে সবকিছুর আধার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং দেহের মধ্যেই বাউলরা আত্মা, পরমাত্মা বা পরম তত্ত্বের অনুসন্ধান করেন। বাউলরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, মানব দেহ হচ্ছে অমূল্য সম্পদ এ দেহ পবিত্র দেহেই পরমাত্মা পরমতত্ত্ব বা মনের মানুষ আলেক সাঁইয়ের বাস। তাই ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রে বাউলদের কোনো আস্থা নেই। পরকাল, স্বর্গ, বেহেস্ত ইত্যাদির কোনো উল্লেখ বাউলবাদে নেই। বর্তমানেই বাউলদের আস্থা। ধর্ম-বর্ণ-জাত বিজাতের ভেদ বাউলরা মানে না । হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সবাই এখানে সমান তাই বলা হয় মানবতাবাদের উৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটেছে বাউল দর্শনে।
লোকায়ত দৰ্শন : লোকায়ত দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বিকশিত সবচেয়ে প্রাচীন দার্শনিক মতবাদ । লোকায়ত দর্শনের অপর নাম চার্বাক দর্শন, ভারতীয় চিন্তার জগতে লোকায়ত দর্শনের আবির্ভাব কোন কাল পর্বে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। সাধারণভাবে লোকায়ত দর্শন বলতে আমরা জনসাধারণ্যে ব্যাপ্ত ও বিকশিত দর্শনকেই বুঝি। লোকায়ত মানে “লোকেষু আয়ত অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত। আবার, চার্বাক কথার অর্থ হচ্ছে চর্বন করা বা খাওয়া। অনেক গবেষক মনে করেন, ‘চর্ব’ ধাতু থেকেই চার্বাক শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ খাওয়াদাওয়া বা পার্থিব সুখ ভোগই চার্বাক দর্শনের লক্ষ্য হওয়ায় এ দর্শনের এ নাম। অনেকের মতে মহর্ষি বৃহস্পতি আবার কারো মতে চার্বাক নামক একজন ঋষি এ মতবাদের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা আবার অনেকের মতে লোকায়ত বা চার্বাক মতবাদ কোনো একজন ব্যক্তির হাতে নয় বরং চার্বাক মতবাদ একটি সম্প্রদায় হিসেবে বিকশিত হয়েছে। যাহোক, লোকায়ত দর্শন সমাজের প্রচলিত ধর্মদর্শনের প্রতিদর্শন। বস্তুবাদী দর্শন হিসেবেই এ দর্শন সমাজ প্রচলিত বেদ-বেদান্ত ভাবাদর্শের বিরোধী দর্শন। এ দর্শন পরলৌকি, ধর্ম, ভবিষ্যৎ, ইত্যাদির পরিবর্তে মর্ত্য, মর্ত্যের মানুষ ও বর্তমানেই নিবিষ্ট। বেদ-বেদান্ত, ঈশ্বর, পরকাল, স্বর্গ ইত্যাদির কোনো ইঙ্গিত চার্বাক দর্শনে নেই। এ দর্শন মানবকেন্দ্রিক, বাস্তবমুখী ও মানুষের ইহজগতের সুখ ভোগকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।
বাউল মতের উপর লোকায়ত দর্শনের প্রভাব : লোকায়ত দর্শন ভারতীয় দর্শনের সবচেয়ে প্রাচীন ও জনসাধারণ্যে পরিব্যাপ্ত দর্শন বিধায় এ দর্শনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল অত্যন্ত বেশি। জনগণের মুখে মুখে ব্যাপ্ত বলে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষে, সাধারণ জনগণও তাদের নিজস্ব দর্শন হিসেবে একে গ্রহণ করেছিলেন অবলীলায়। ফলে এ দর্শন তার সুপ্রশস্ত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল পরবর্তী কালের দর্শন ও জীবন চিন্তায়। তাই দেখা যায় লোকায়ত দর্শনে পরবর্তী কালের প্রায় সকল ভারতীয় দর্শনে এ দর্শনের কম বেশি আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। লোকায়ত দর্শনের
এ ক্রমবিকশিত প্রভাবেরই একটি প্রভাব আমরা লক্ষ করি বাউল দর্শনে। অনেক বাউল গবেষক ও পণ্ডিত মনে করেন বাউল দর্শনে মানবকেন্দ্রিক বা মানবতাবাদী মতের যে পরম বিকাশ ঘটেছে তা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। চার্বাক দার্শনিকগণ স্বর্গের দেবতাকে নয় মতের মানুষকেই বড় করে দেখেছেন। তাই মানুষের ইহলৌকিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, কল্যাণ কামনা ইত্যাদি এ মানুষের মাধ্যমেই তারা প্রত্যাশা করেছেন। মানুষের মুক্তি চার্বাকদের মতে, মানুষের মাধ্যমেই কোনো স্বর্গীয় আদিমানবের মাধ্যমে নয়। বাউল দার্শনিকগণও চার্বাক দর্শনের এ তত্ত্ব গ্রহণ করে মানুষের মুক্তি মানুষের কাছে মানুষ ভজনার মাধ্যমে বলে তারা
মানুষ ভজনের কথা বলেছেন। বাউলদের মতে, মানুষ ভজন করলেই সেই পরম মানুষকে পাওয়া যায়। ফকির লালনের ভাষায়-
‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্য জ্ঞানে পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে। চার্বাক দর্শনে মানুষকে কেমন সবার চেয়ে বড় গণ্য করা হয়েছে তেমনি বাউল দর্শনেও মানুষকে স্বর্গ দেবদেবী সবার উপরে স্থান দেয়া হয়েছে। বাউল দর্শনে মানুষের উপর আস্থা রেখে বলা হচ্ছে যে, এ মানুষের উপর আমরা যদি আস্থা না রাখি তবে আমাদের মোক্ষ লাভ তো হবেই না বরং আমরা আমাদের মূল হারিয়ে ফতুর হবো। বাউল দর্শনের পরকাল, ঈশ্বর, বেহেস্ত বিরোধী যে মনোভাব দেখতে পাওয়া যায় তা লোকায়ত দর্শন প্রসূত বলে মনে করা হয়। চার্বাকরা যেমন পরলৌকিক সুখ, পরকাল চিন্তা, স্বর্গ ইত্যাদিকে অস্বীকার করেছেন, পরলৌকিক ধর্ম ও সুখের মোহে বৈষয়িক সুখকে বিসর্জন না দেয়ার কথা বলেছেন; বাউলরাও তেমনি ঠিক অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন তাঁদের দর্শনে। যেমন- বাউল সম্রাট লালন বলেছেন-
“শুনি মরলে পাব বেহেস্ত খানা
তা শুনে তো মন মানে না
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে ভুবনে।”
অর্থাৎ, বেহেস্ত থাকলে, বেহেস্তের সুখ থাকলে তা এ জীবনেই প্রাপ্য, মরার পর পরজীবনের বেহেস্তের সুখের লোভ বাউলকে আশ্বস্ত করতে পারে না। কারণ চার্বাকদের মতো বর্তমানই বাউলদের কাছে সারবস্তু । বর্তমানের এ মানবজীবন তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। তারা এ জীবনেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে চায়। চায় জীবনে অনাবিল শান্তি। চার্বাকদের যেমন কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তেমনি বাউলেরাও ভবিষ্যতের আশা করে না; ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে না। তারা বর্তমানকেই সমুদয় ধরে সাধনা করতে চায়। বাউল দর্শনের বিদ্রোহীভাব, প্রচলিত আচার-আচরণ, শাস্ত্রাচার ও সমাজের বিরুদ্ধে দ্রোহের মনোভাবেও আমরা লোকায়ত দর্শনের প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। চার্বাক দর্শন যেমন- তৎকালীন সমাজের কঠিন শাস্ত্রাচার আর যাগযজ্ঞের ঘেরা টোপে আবদ্ধ-শৃঙ্খলিত মানবজীবনকে ভেঙে মানুষকে সহজ মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছিল, বাউল দর্শনও তেমনি প্রচলিত বর্ণ বিভক্ত সমাজব্যবস্থা, শাস্ত্রাচার ও বিধিবিধানের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করে মানুষকে সহজ মুক্তির পথে ধাবিত করতে চান, চার্বাক ও বাউল দর্শনের এ বিদ্রোহের সুর একই মূলে গৃহীত। তাছাড়া বাউলদের দেহতত্ত্ব, গুরুবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও লোকায়ত দর্শনের প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, লোকায়ত ও বাউল দর্শনে এরূপ মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও বাউল দর্শন বাংলার আবহে বিকশিত বাঙালির নিজস্ব দর্শন। আর এ বিকাশের পথে বাউল দর্শন বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন থেকে তার প্রয়োজন অনুসারে উপাদান গ্রহণ ও বর্জন করেছে সত্য কিন্তু কোনো দর্শনের নিকট তাদের স্বকীয়তা বিকিয়ে দেয়নি। তাই বাউল দর্শন ও লোকায়ত দর্শনের আলোচিত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে গবেষক ও পণ্ডিতগত যে প্রভাবের কথা বলেন তা মূলত অনুমান নির্ভর । এ অনুমানকে সঠিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হলে আরো বাস্তবভিত্তিক তথ্য গবেষণা প্রয়োজন ।