বাউল দর্শনের মানবতাবাদী আদর্শ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনে মানবতাবাদী আদর্শ বর্ণনা কর।
অথবা, বাউল দর্শনে মানবতাবাদী আদর্শ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাউল দর্শনে মানবতাবাদী আদর্শ আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাউল দর্শন বাংলার দর্শন; বাঙালি দর্শন; বাঙালির নিজস্ব দর্শন। বাংলার নিজস্ব আবহে বাঙালির স্বকীয় মনন বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে বাংলার মাটিতেই বাঙালির দর্শন বিকশিত হয়েছে। মধ্যযুগে বাংলায় বর্ণবাদে কষাঘাতে দ্বিধাবিভক্ত সমাজ কাঠামোতে নিম্নবর্ণের বঞ্চিত, শোষিত ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষের মুক্তি তথা মানুষ ও মানবতার অমর বাণীকে অন্তরে ধারণ করে বাউল দর্শনের উদ্ভব। বাউলরা মানুষ এবং মানবতাকে তাদের সমগ্র সাধন ক্রিয়ার কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেন। বাউল দর্শনে পূর্ববর্তী সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ের মানবতাবাদী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ
ঘটেছে। বাউলরা মানুষের পরমসত্তা লাভের বাহক ও পরম সত্তার ধারক হিসেবে গ্রহণ করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন ।
বাউল দর্শনের মানবতাবাদী আদর্শ : বাঙালির মানবতাবাদী চিন্তাধারা চর্যাপদ থেকে শুরু হয়ে ক্রম বিকশিত। আর বাঙালির চিন্তায় বিকশিত এ মানবতাবাদী আদর্শেরই উৎকৃষ্ট নিদর্শন আমরা দেখতে পাই বাউল দর্শনে। বলা হয় সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই-মানবতাবাদের এ অমর বাণীর চরম ও পরম বিকাশ ঘটেছে বাউল দর্শনে। ধর্ম-বর্ণ, জাত-বিজাত নির্বিশেষে মানুষের ঐক্য, সাম্য ও প্রেমের বাণীই বাউলরা প্রচার করে তাদের গানে ও সাধন ক্রিয়ায়। মানুষ সাধনাই বাউল সাধনা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জ্ঞান করা বাউলরা জানেন না। বাউলদের এ মানবতাবাদী আদর্শের পূর্ণ বিকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁদের শাস্ত্র বিমুখতায়, গুরুবাদে, চারচন্দ্রভেদ তত্ত্বে ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিয়ে বাউলদের মানবতাবাদী আদর্শের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো :
শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড় : বাউলদের মতে, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য, সত্য বড়, আচার-অনুষ্ঠান ও বিধিবিধানের চেয়ে মানুষ বড়। তাঁদের নিকট তত্ত্বের জন্য মানুষ নয়, এমনকি তাঁরা আরো এগিয়ে গিয়ে বলেন যে, মানুষের জন্যও তত্ত্ব নয়। মানুষ কোনো তত্ত্ব বা শাস্ত্রের অধীন নয়। শাস্ত্র সে মানুষ রচিত হোক বা ঈশ্বর প্রদত্ত হোক, শাস্ত্র কখনো মানুষের উপর স্থান পেতে পারে না। শাস্ত্র মানা যেমন মানুষের উচিত নয় তেমনি শাস্ত্র প্রণয়ন করাও মানুষের কাজ নয়। মানুষ সাধনার মাধ্যমে নিজেকে জানবে এবং নিজেকে জানা ও উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকৃত আত্মার সন্ধান পাবে। তাই বাউলদের কাছে শাস্ত্ৰ বা তত্ত্ব নয়, মানুষই সবচেয়ে বড়। সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। বাউলরা মানুষকে সকলের উপরে স্থান দেন। মানুষকে আশ্রয় করে তাঁরা সাধনা করেন।
মানুষই মানুষের পথপ্রদর্শক, মুক্তিদাতা : বাউলরা মানুষের বাইরে অন্য কোন তত্ত্ব স্বীকার করে না। বাউল মতে, মানুষ ছাড়া মানুষের কোনো মুক্তি নেই। বাউল তার অপূর্ণতার কথা, তার প্রাপ্তির কথা, তার খেদ আল্লাহ সবকিছুই এ মানুষেই সমর্পণ করতে চান। এ মানুষই তার পবিত্রাতা। এ মানুষ তার সমাজের তার মতো মানুষ যে মানুষ তাকে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ বাতলে দেয়। বাউলদের গুরুবাদে এ বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। গুরুবাদানুসারে মানুষই মানুষকে পথ দেখাতে পারে। এর জন্য কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রয়োজন নেই। তাই বাউলরা মানব গুরুরই দ্বারস্থ হয়।
তাঁরা গুরুকে দু’ভাবে কল্পনা করেন, মানুষরূপে এবং মানুষরূপী স্বয়ং ঈশ্বররূপে। গুরু বা মুর্শিদ যে এ জগতে পরম সম্পদ এবং ঈশ্বর স্বয়ং যে গুরুরূপে শিষ্যকে সাধন পথে পরিচালিত করেন বাউলদের তেমনই বিশ্বাস তাঁদের এ ঈশ্বর বেদের ঈশ্বর বর্ণ বা মানুষ বহির্ভূত কোন সত্তা নন। মানুষই সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব লাভ করে, গুরুরূপে অন্যদের শিষ্যত্ব প্রদান করে সিদ্ধির পথ দেখান। কোন অদেখা ঈশ্বর নয়, কোন পুস্তকী দর্শন নয় মানুষ গুরুই মানুষকে পরিপূর্ণতা দান করতে পারে। এ যে মানুষকে ঈশ্বরের স্থানে প্রতিস্থাপন করার মতো মানবতাবাদী চিন্তা তা বাউলদের আর কেহ করেছে কিনা তা অবশ্যই ভেবে দেখার অবকাশ রাখে। তাইতো বাউল একমাত্র মানুষ ভজনের মাধ্যমে মানবজীবনকে সার্থক করে তোলার কথা বলেন। বাউল সম্রাট লালনের ভাষায়, “মানব গুরু কল্পতরুভজ মন, মানুষ হয়ে মানুষ ভজ পাক মানুষ মানুষ রতন।”
মানব দেহ পবিত্র তীর্থভূমি : মানব দেহের সাধনাই বাউল সাধনা। মানব দেহই বাউলদের কাছে সবচেয়ে বড় তীর্থ ব্রতের স্থান। এ মানব দেহের চেয়ে পবিত্র তীর্থভূমি এ পৃথিবীতে আর নেই। এ মানব দেহেই মক্কা, মদিনা, গয়া, কাশি বর্তমান। তাই বাউলরা এ মানব দেহেরই আরাধনা করে। লালন বলেন-
“আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখনারে মন ভেয়ে
দেশ দেশান্তর দৌড়ে
মরছ কেন হাঁপিয়ে।”
বাউলদের এ দেহ সাধনার মানবতাবাদের পূর্ণ বিকাশ পরিলক্ষিত হয় তাঁদের চারচন্দ্রভেদ সাধনার গূঢ় তত্ত্বে। এ তত্ত্ব মতে, মানুষ এমন এক সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যে তার কোন অংশই ঘৃণার নয়। চারটি চন্দ্র একের পর এক ভেদ করার সাধনায় বাউল সাধক সার্থক হয়ে এ তথ্যটিই প্রমাণ করে দেয় যে, মানব দেহ অতিপবিত্র এবং দেহই পরমাত্মার মন্দির, মসজিদ। এ দেহের সাধনার মাধ্যমেই পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়।
মানুষ সকল প্রকারভেদ ও বর্ণ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে : মানুষ মানুষে কিংবা ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়গতভেদ বাউলরা মানেন না। এ অসাম্প্রদায়িক চেতনা দর্শনের মানবতাবাদী আদর্শের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, খ্রিস্টান সকলের জন্যই বাউলের দ্বার উন্মুক্ত। সবার জন্য একই তত্ত্ব, একই সাধন পদ্ধতি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, ধর্মে ধর্মে বাড়াবাড়ি, জাতিতে জাতিতে জাঁতাজাতি ইত্যাদি দেখে বাউলরা শঙ্কিত হয়েছেন। বর্ণবাদের রোষানলে পড়ে তাঁরা শোষিত বঞ্চিত হয়েছেন। তাই তারা ভঙ্গুর জাতপাতের অন্ধকার ঘেরা কবজে মানবতাবাদী দর্শনের আলোর মশাল জ্বালাতে চেয়েছেন। তাইতো বাউলকূল শিরোমণি লালন বলেন,
“জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবি দেখি তা না না।”
সবচেয়ে বড় কথা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ একই বিশ্বমানবতার অন্তর্ভুক্ত এটাই বাউলদের বিশ্বাস বাউলরা তাই গায়-
“নানা বরণ গাভীরে একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।”
দুনিয়ার সব মানুষ। সমান, সার্বজনীন ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব যেসব ধর্মের মূল শিক্ষা সব আধ্যাত্ম ও যথার্থ দর্শনের লক্ষ্য ও যে এক ও অভি, তারই অভ্রান্ত ইঙ্গিত নিহিত বাউলদের উচ্চারিত এ দুটি লাইনে। আর এ আদর্শের অনুসারী বলেই বাউলরা মানুষ কেবল মানুষের মধ্যেই খুঁজে বেড়ান জগৎ ও জীবনের নিগূঢ় তত্ত্বকে। তাই বাউলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মানবতার কথা। বাউল তাই বিশ্বময় মানুষ দেখতে পান, দেখতে চান। লালনের ভাষায়-
“যথা যাই মানুষ দেখি
মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপে বলা যায়, মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তা-আবিষ্কার করে মানুষকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা এবং মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়ে মানবতার জয়গান করা যদি মানবতাবাদী দর্শনের মূল কথা হয় তাহলে বাউলবাদে যে মানবতাবাদের পরম ও চরম বিকাশ ঘটেছে। তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, থাকতে পারে না। তাইতো একজন পণ্ডিত যথার্থই মন্তব্য করেছেন সমাজের উপর তলার লোকের ধর্ম হলে, এ মতবাদ যে কেবল বাঙালি জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতো তা নয়, দুনিয়ার মানুষের কাছে উদার মানবিকতার জন্য বাঙালিকেও শ্রদ্ধেয়ও করে তুলতো।