বাউল দর্শনের দেহতত্ত্ব বা ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ডবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, যাহা নাই ভাণ্ডে তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’ বাউলদের এ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের আলোকে দেহতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের আলোকে ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ডবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনে ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ডবাদ কী?
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাঙালির নিজস্ব আবহে ও মননে বিকশিত দেহসাধনভিত্তিক একটি মরমি আদর্শিক ভাবধারা হচ্ছে বাডল দর্শন। বাউলদের সমগ্র চিন্তাধারা ও সাধন ক্রিয়ার মূল কেন্দ্র বা উৎস হচ্ছে দেহ। অর্থাৎ দেহের সাধনাই হচ্ছে বাডল সাধনা। বাউলদের এই দেহ সাধনা জ্ঞান, কর্ম, ভাব-ভক্তি ও প্রেমের উপর প্রতিষ্ঠিত। আত্মতত্ত্ব জানার সাধনা মানবদেহের মধ্যেই পরমাত্মা, মনের মানুষ বা আলেখসায়ের বাস, এমনকি বিশ্বের যাবতীয় কিছুর অধিষ্ঠানও এই যা ক্রমান্বয়ে দেহ হতে দেহাতাত অধ্যাত্মতত্ত্বের সহজ জ্ঞান লাভে সাহায্য করে। বাউলরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন মানবদেহে। তাই তাদের উক্তি ‘যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’ ।
দেহতত্ত্ব বা ভা ব্রহ্মাণ্ডবাদ : মানবদেহ বাউল ধর্ম, দর্শন ও সাধনার মূলভিত্তি। দেহের সাধনাই বাউল সাধনা। বাউল মতে, পঞ্চেদ্ৰীয় যুক্ত দেহ সকল শক্তির আধার এবং আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র অবলম্বন। দেহের তুষ্টিতেই সকল সাধনার তুষ্টি। বাউলদের কাছে মানবজীবন ও মানব দেহ পরম সম্পদ। দেহের অভ্যন্তরেই সকল বস্তু বিদ্যমান। এ দেহের মধ্যে মূলতত্ত্ব, আত্মা পরমাত্মা, পরমগুরু ও পরম তত্ত্বের বাস। তীর্থ, ধর্ম, বারোব্রত, পূজা, তপ, জপ ইত্যাদি সমস্তই দেহে মিলে, দেহের সাধনা সর্ব সাধনার শ্রেষ্ঠ সাধনা। মানব দেহকে আশ্রয় করেই মানুষের প্রেম ও সাধন অজন। বাউলদের মতে, এ মানবদেহ ও মানবজীবন অতি অমূল্য বস্তু কারণ মানুষ পরম তত্ত্বের প্রতিনিধি, মানুষের মধ্যেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও পরম তত্ত্ব প্রতিবিম্বিত হয়। মানুষের মধ্যেই সোনার মানুষ, মানুষ রতন, মনের মানুষ, নূরনবী ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া যায়। তাই তাঁরা দেহের সাধনার মাধ্যমেই মনের মানুষের সন্ধান করেন। দেহ সম্পর্কে বাউলদের মূল বক্তব্য হলো— ‘যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’- অর্থাৎ, মানবদেহের বাইরে বা ভাণ্ডের বাইরে আর কিছুই নেই। বাউলরা দেহের মধ্যে বিশ্বের মূল উৎসের সন্ধান পান। মানবদেহ ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড, দেহের মধ্যে যেমন পরম তত্ত্ব বা পরমাত্মার বাস তেমনি এ মানবদেহের মধ্যে মাটি, জল, তেজ, বায়ু, ব্যোম, সপ্ত পাতাল, সপ্ত ঊর্ধ্বলোক, সপ্তদ্বীপ, সপ্তসাগর, সপ্ত পর্বত ইত্যাদি আছে। এ দৃশ্যমান পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা এ দেহে আছে। অর্থাৎ, মানবদেহ একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। তাই লালন , “যে লীলে ব্রহ্মাণ্ডের পর সেই লীলে ভাণ্ড মাঝার।” বলেন, মানবদেহের মধ্যেই আছে মনের মানুষ আর এ সাধনাই হচ্ছে বাউল সাধনা। বাউল সাধক স্রষ্টা বা আল্লাহকে বাইরের জগতে খুঁজে পান না। তিনি নিজের মধ্যে তথা মানবদেহের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করেন। যে সত্তা বাউলের শব্দে, গন্ধে, বর্ণে এবং অসংখ্য ছন্দ ভঙ্গিতে ইন্দ্রিয় গ্রামকে অধিকার করে আছে সেই সত্তাই অন্তরে ইন্দ্রিয়াতীত রূপে কেবল মানসবৃত্তে পরম বিস্ময়ে স্ফুটিত। এ পরম সুন্দর বাউলের অন্তরে সৃষ্টি করে ভাবের উন্মাদনা, তাকে করে ভাবের উন্মাদ, প্রেমের পাগল । বাউল আপনাকে হারিয়ে ফেলে সবকিছু একাকার হয়ে যায়। বাউলের দেহভিত্তিক সাধনায় এ স্রষ্টার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার মরমি সুর বেজে উঠে। এ সুরই বিধৃত হয়েছে লালনের গানে যেখানে লালন বলেছেন-
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তার পায়।”
এ খাঁচা মানবদেহ, পাখি রুহ বা আত্মা।
আবার তিনি বলেন,
“হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি,
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায় ঐ খেদে ঝরে আঁখি।”
এ পাখিও আত্মা, দেহের খাঁচায় জীবনব্যাপী আত্মা নামের পাখি পোষার পরও তার পরিচয় সহজে জানা যায় না, এ দুখে লালনের আঁখিতে অশ্রু ঝরে। মানবদেহে অবস্থিত মনের মানুষ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন,উপনিষদে আবার সে কথাই আপন ভাষায় বলেছে নিরক্ষর অশাস্ত্রজ্ঞ বাডল। সে আপন দেবতাকে জানে আপনার মধ্যেই, তাকে বলে মনের মানুষ, বলে মনের মানুষ, মনের মাঝে করো অন্বেষণ।” অতএব, পরমাত্মা বা মনের মানুষের সন্ধানে।মানবদেহের মধ্যে অন্বেষণের সাধনাই বাউল দেহতত্ত্ব বা দেহ সাধনা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাউল ধর্ম, দর্শন, সাধনা ও সাধনার অন্যান্য সকল তত্ত্বের মূলভিত্তি হলো দেহতত্ত্ব। দেহের সাধনার মাধ্যমেই বাউলরা তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে সচেষ্ট হন। তাই বাউল মতে, দেহ হলো পবিত্র এবং পবিত্র দেহেই সবকিছুর অধিষ্ঠান। দেহের বাইরে আর কিছুই নেই।