বাউলবাদ একটি সমন্বয়ী মতবাদ ধারণাটি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বিভিন্ন মত ও পথের সমন্বয়ে বাউল দর্শনের উদ্ভব-বিষয়টি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউলবাদকে সমন্বয়ী মতবাদ বলার কারণ কী?
অথবা, বাউলবাদকে সমন্বয়ী মতবাদ বলা হয় কেন?
অথবা, বাউলবাদকে সমন্বয়ী দর্শন বলা হয় কেন?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাউলবাদ বাংলার দর্শন, বাঙালির দর্শন, বাঙালির নিজস্ব চিন্তাধারার ফসল। বাঙালির চিন্তাচেতনা, জীবনবোধ, ধ্যানধারণা ও মননবৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে বাংলার উর্বরভূমিতে বিকশিত হয়েছে বাউল মত। আর এ বিকাশের পথে বাউল মত তার প্রয়োজন অনুযায়ী নানান দার্শনিক মত ও পথের তত্ত্ব গ্রহণ ও বর্জন করেছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে বাউল দর্শন কোনো দর্শনের ছায়াতলে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেনি। বরং বাঙালির নিজস্ব জীবনাদর্শকে সমুন্নত রেখেই বিভিন্ন মতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাউল মতবাদ।
বাউলবাদ একটি সমন্বয়ধর্মী মতবাদ : বাউল মতবাদ একটি সমস্বয়বাদী মতবাদ। এ মতবাদ বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন থেকে নির্যাস নিয়েছে সত্য, কিন্তু কোনো ধর্ম বা দর্শনের মধ্যে তার সত্তা হারিয়ে ফেলেনি বরং সকল মত ও পথ থেকে নির্যাস নিয়ে নিজের মতো করে এ মতবাদ বিকাশ লাভ করেছে বাংলার নিজস্ব আবহে। মধ্যযুগের বাংলার অতি নিম্নবর্ণের হত-দরিদ্র সাধারণ জনতার জগৎ জীবনভাবনার সাথে আবহমান বাংলায় বিকশিত ও বহিরাগত নানা মতবাদের মূলসারের সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে বাউল মত। তাই বলা হয়, বাউল দর্শন আমাদের লোকায়ত দর্শন এবং এ ভূমিতে বিকাশমান নানা দর্শনের নির্যাস নিয়ে আলাদাভাবে বিকাশ লাভ করেছে। বাউল সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত বাংলার নিম্নশ্রেণির সুবিধাবঞ্চিত ভাগ্যাহত মানুষ। প্রচলিত সমাজ ধর্মে আশ্রয় না পাওয়া এ মানুষগুলো নানা সময়ে নানান ধর্মের ছায়াতলে গিয়ে মুক্তির পথ খুঁজেছে। কিন্তু হতভাগ্য মানুষগুলো কোনো ধর্মের আশ্রয়েই জীবনের মানে খুঁজে পায়নি। জাতের সংস্কার ঘেরা হিন্দু সমাজের কঠিন শোষণ থেকে মুক্তিলাভের আশায় তারা এক সময় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে।কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম যে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি তাদের দিতে পারেনি। ফলে তারা মুক্তির নতুন পথ খুঁজতে থাকে। এক সময় বাংলায় জাতিভেদহীন ও উদার মানবতাবাদের বাণী নিয়ে সুফিবাদের আগমন হলে তারা মুক্তির আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু হিন্দুধর্মের আদলে বহিরাগত মুসলমানরা ক্রমেই নিজেদের অভিজাত শ্রেণির সদস্য গণ্য করে একটা প্রচ্ছন্ন ভেদ-বিভেদের প্রাচীর তুলে সমাজের হতভাগা মানুষদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ রুদ্ধ করে দেয়। ষোল শতকে শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলনের ফলে এই অন্ত্যজ শ্রেণি মুক্তির দিশা দেখতে পেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর পর তাঁর ভাবান্দোলন সমাজে সংস্কারযুক্ত পণ্ডিতদের পকেট বন্দি হলে সমাজের হতভাগ্যগুলো জীবন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আবার নতুন পথের সন্ধান করতে থাকে। আর তারই ফলশ্রুতি হচ্ছে বাউল ধর্মের উদ্ভব। কিন্তু বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও
এসব মানুষের মধ্যে তাঁদের গৃহীত পূর্বমত ও পথের কিছু কিছু প্রভাব উত্তরাধিকারসূত্রে রয়ে গেছে। বলা যায়, প্রচলিত সব ধর্ম ও মতের প্রভাবকে ধারণ করেই তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে বাউল মত গড়ে উঠেছে। যদিও বলা হয় বাউল মতবাদের উপর সুফি মতের প্রভাব সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট, তথাপি বাংলার লোকায়ত দৰ্শন, সুফিদর্শন, বৈষ্ণব দর্শন, বৌদ্ধদর্শন,জৈন দর্শন, তন্ত্র দর্শন, শাক্ত দর্শন প্রভৃতির প্রভাবের সমন্বয়েই বাউল দর্শন পূর্ণতা লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এ মোঃ আব্দুল করিম মিঞা তাঁর টাঙ্গাইল অঞ্চলের বাউল গান স্বরূপ ও দর্শন’ গ্রন্থে যথার্থই মন্তব্য করেছেন :
“বাউল মত ও পথ প্রবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন ধর্মদর্শনের ভিত্তিতে, সামাজিক পীড়নে ও রাজনৈতিক কারণে। সমাজের অবহেলিতজনেরা ধর্মীয় ও সমাজজীবনে নানা রকম পীড়নের শিকার হওয়ায় সমাজ ও ধর্মের প্রতি ভাবের সৃষ্টি হয়। এ
দ্রোহ ভাব থেকেই তারা মসজিদে বা মন্দিরে না গিয়ে স্বাধীন মতবাদের চর্চায় আত্মনিয়োগ করে।”
উপসংহার : সুতরাং এ সত্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট বাউল মতবাদ একটি সমন্বয়ী মতবাদ, বাউলবাদ বাঙালির নিজস্ব চিন্তার ফসল হলেও বিভিন্ন মতের সমন্বয়েই রচিত হয়েছে এ মতবাদের ভিত্তি ভূমি। কিন্তু তাই বলে বাউলবাদ কোনো মতবাদের মধ্যে তার স্বকীয়তাকে হারিয়ে ফেলেনি।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*