বাউলবাদের অধিবিদ্যক দিক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বাউল দর্শনের ইহজাগতিক অধ্যাত্মবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের অধিবিদ্যক আলোচনা তুলে ধর।
অথবা, বাউল দর্শনের অধ্যাত্মবাদ সংক্ষেপে তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম ও দর্শন তথা জগজ্জীবন ভাবনার পরিসরে বাউলবাদ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তৎকালীন বর্ণবিভক্ত সমাজের নিম্নবর্ণের অতিসাধারণ মানুষের জগজ্জীবন ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে বাউল ধর্ম ও দর্শন। অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষের দর্শন বলেই হয়তো বাউল দর্শনে পরলৌকিক জীবন বা অতীন্দ্রিয় সত্তার অনুসন্ধানের কোনো ব্যাপার নেই, বরং তাঁদের চিন্তা বাস্তব জীবনমুখী বা ইহজগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
বাউল দর্শনের অধিবিদ্যক দিক/ইহজাগতিক অধ্যাত্মবাদ : বাউল দর্শনের অধিবিদ্যক বা তত্ত্ববিদ্যক দিকটি অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এর তত্ত্বীয় দিকটি ইহজাগতিক অধ্যাত্মবাদের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। বাউলবাদে ইহজাগতিকতার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ আর আধ্যাত্মিকতা পরোক্ষ হলেও অস্পষ্ট নয়। বাউল মতের অধিবিদ্যক দিকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো দেহ। বাস্তব মানবদেহ কেন্দ্র করেই তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনা। বাউলদের মতে, মানবদেহই হলো পরম সত্য। এ দেহের মধ্যেই নিহিত আছে, সকল জ্ঞানের ও কর্মের উৎস ও উদ্দেশ্য। মানবদেহেই পরমাত্মার বাসা। তাঁরা বিশ্বাস করে, “এই দেহেতেই কৈলাস, এই দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহেতেই মক্কা-মদিনা এবং ‘দেহবিনা নাইরে উপায়’ আর আপন ভাণ্ডে খুঁজলে পরে সকল জানা যায়।” তাই বাউলরা এ দেহের মধ্যেই পরমাত্মা বা পরম তত্ত্বের অনুসন্ধান করে। অর্থাৎ, ইহজাগতিক দেহ এবং দেহের বাসিন্দা পরমাত্মা তথা অধ্যাত্ম সত্তা এ দু’য়ের সম্মিলনেই গড়ে উঠেছে বাউলদের ইহজাগতিক অধ্যাত্মবাদ। দেহের বাইরে কোনো তত্ত্ব বা অতীন্দ্রিয় সত্তার ধারণা বাউলরা স্বীকার করে না। পারলৌকিক চিন্তাভাবনা বা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কোনো ইঙ্গিত বাউলদের গানে নেয় ৷ তাদের সাধন পদ্ধতিতেও মোক্ষপ্রাপ্তি বা স্বর্গপ্রাপ্তির কোনো উল্লেখ নেই।দেহ বা ভাণ্ডই আত্মার আধার। দেহেই সকল তত্ত্ব ও সাধনার উৎস। দেহের মধ্যে খুঁজলেই পরমাত্মা পরম তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে দেহের মাধ্যমে আত্মাকে উপলব্ধি করতে হয় বা পুরুষ ও প্রকৃতির যথার্থ সম্মিলনেই পরমাত্মার প্রকাশ ঘটে। এ দেহের মধ্যে পরমাত্মার উপলব্ধিই হলো বাউল সাধক জীবনের চরম লক্ষ্য। এথেকে অনুমেয় যে মন বা আত্মা মানুষের দেহেই অবস্থ করে। ইহজাগতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার তথা দেহ ও মনের এই যে সমন্বয়ী তত্ত্ব তাই বাউলবাদের অধিবিদ্যক তত্ত্ব। এ সমন্বয়ী তত্ত্বেরই একটি সুন্দর প্রতিফলন। আমরা দেখতে পাই অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্ৰ দেবের চিন্তাধারায়। সাধারণ মানুষের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার দিকটিকেই তিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর সমন্বয়ী ভাববাদে। তাঁর মতে, বস্তুবাদ যেমন মানুষের ‘হাতের নিকট স্বর্গ এনে দেয় না বা দিতে পারে না, তেমনি অধ্যাত্মবাদও স্বর্গের জন্য নিরাপদ কোনো ছাড়পত্র দেয় না বা দিতে পারে না। এক্ষেত্রে তাঁর মৌলিক নীতিটি হচ্ছে- কোনো কিছুর অস্বীকৃতি নয় বরং জড় ও আত্মা এ উভয়েরই অনুমোদন বা স্বীকৃতি প্রয়োজন। ইহজাগতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার এ স্বীকৃতিটিই আমরা দেখতে পাই বাউলদের মতাদর্শে। বাউলরা তাঁদের সাধন পদ্ধতি ও মতাদশে ঈশ্বর
ও পরলোকের অস্তিত্বকে অস্বীকার না করে মানুষের দেহ ও আত্মার প্রয়োজনের মধ্যে একটি সুন্দর সিম্ফনিতুল্য সমন্বয়সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। আর এখানেই নিহিত রয়েছে বাউল মতবাদের প্রকৃত গুরুত্ব ।
উপসংহার : অতএব দেখা যাচ্ছে, দেহতত্ত্ব বা ভাণ্ডবাদের মধ্যেই বিকশিত হয়েছে বাউলবাদের ইহজাগতিক অধ্যাত্মবাদ। মানবদেহই হচ্ছে মূল, এর বাইরে কিছুই নেই। এখানে খুঁজলেই সবকিছুই পাওয়া যায়। এ ভাঙেই পরমাত্মার বাস তাই ভাণ্ডই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড, ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ যে নামই সে পরমাত্মাকে দেয়া হোক না কেন মানুষের মধ্যেই তাঁর বাস। তাই বাউলরা মানবদেহের মধ্যেই পরমাত্মার অনুসন্ধান করে চলে নিরন্তর।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*