বাংলার নবজাগরণের প্রভাত নক্ষত্র যে রাজা রামমোহন রায় সে সমন্ধে কোনো মতভেদ নেই”- এ উক্তির আলোকে রামমোহন রায়ের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা কতটুকু তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : উদার মানবিকতাসম্পৃক্ত, বিচারপরায়ণ ও নির্ভীক এক শিল্পীর নাম কাজী আবদুল ওদুদ। যুক্তিনিষ্ঠতায় এবং চিন্তাশীলতায় তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলো বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধটিতে লেখক বাংলার জাগরণে যে সকল মনীষী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের সম্পর্কে যুক্তিনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন। বাংলার জাগরণে যে সকল মনীষীর অবদান অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় অগ্রগণ্য।
রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় : বাংলার জাতীয় জাগরণের প্রভাত নক্ষত্র রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে তিনি একদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা সম্প্রসারক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকারী; অন্যদিকে, তিনি ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বাদির মতো জটিলতর বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী এ মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে প্রভূত সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর গৃহে সে আমলে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের সমাগম ঘটত। ১৮৩০ সালে তিনি ইংল্যন্ডের রাজার নিকট দূত হিসেবে গমন করেন। সেখানেই ক্ষণজন্ম এ পুরুষের ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে জীবনাসান ঘটে।
জাতীয় জাগরণের অগ্রনায়ক : রাজা রামমোহন রায় বাংলার জাগরণের অগ্রনায়ক। রামমোহনের নবচিন্তা ও ভাবধারার মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয়। রামমোহন ছিলেন বহুগুণের অধিকারী। একদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর সৃষ্টি প্রেরণার অন্যতম উৎস। রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্য দিয়ে সনাতন হিন্দু ধর্মে নতুন ভাবধারার সূচনা হয়। রামমোহনকে তাই বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে “প্রভাতসূর্য” বলা হয়। ধর্মচিন্তা, শিক্ষাবিস্তার, সমাজ সংস্কারের মতো হিতকরী কাজে রামমোহনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে শত বছরে বাংলায় এমন কোন কর্মীর জন্ম হয়নি। একেবারে আধুনিক কালের সমস্ত মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন রামমোহন রায়।
রামমোহনের ধর্মচিন্তা : রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্য দিয়ে সনাতন হিন্দুধর্মে নতুন ভাবধারার সূচনা হয়। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাদর্শে বিশ্বাসী রামমোহন রায়ের উন্মুক্ত মন সনাতন হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, অবতারবাদ ইত্যাদি মেনে নিতে পারেনি। এজন্য তিনি পিতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে বাদানুবাদ করেছেন, গৃহত্যাগ করে তিব্বত ও উত্তর ভারতসহ অনেক স্থান ভ্রমণ করেছেন। আর এসমস্ত স্থানে ভ্রমণের ফলে নানক, কবীর প্রভৃতি ভক্তদের ভাবধারার সাথে পরিচিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছেন দাদু আকবর, আবুলফজল, দারাশেকো প্রভৃতি ভক্ত ভাবুক ও কর্মীর চিন্তা-চেতনার। এভাবেই ধর্মচিন্তায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষায় তাঁর অপরিসীম দক্ষতা ছিল। ফলে হিন্দুধর্মসহ ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থে তিনি ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন : রামমোহন রায় ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একজন সফল সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘সতীদাহ প্রথা’ হিন্দুধর্মের একটি ঘৃণিত প্রথা হিসেবে সমাজে চলে আসছিল। রাজা রামমোহন রায় এ ঘূর্ণিত প্রথার বিলোপ সাধনে আন্তরিকভাবে লড়াই করেছেন। তিনি এ বিষয়ে ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইন প্রণয়ন করিয়েছেন। রামমোহনের কল্যাণেই হিন্দু সমাজ সতীদাহ প্রথার মতো একটি জঘন্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করেছে। মুক্তির স্বাদ নিয়েছে অগণিত নিরপরাধ বিধবা নারী।
জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় রাজা রামমোহন রায় : জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় রাজা রামমোহনের প্রদর্শিত পথের সুফলতাই ভোগ করছে জাতি। জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা আবশ্যক একথাটি তিনি জানতেন ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনি সমাজে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। আর এজন্য তিনি সংবাদপত্রকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশে তিনি নিজেও দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘ব্রাহ্মণসেবধি’ নামে বাংলায় এবং ‘সীরাতুল আকবর’ নামে ফারসি ভাষায় তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তিনি মাতৃভাষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
শিক্ষাবিস্তারে রামমোহনের অবদান : রামমোহন জাতীয় জীবনে যেসমস্ত কর্মের প্রবর্তনার সংকল্প করেছিলেন তার মধ্যে হিন্দু কলেজ অন্যতম। এ হিন্দুকলেজ শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এ কলেজের ছাত্ররাই পরবর্তীতে সমাজের অনেক উঁচু স্থানে আসীন হয়েছিলেন। জাতিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ অনুশীলনের উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রামমোহনের অবদান : অগাধ পাণ্ডিত্য ও হৃদয়ের উদারতা রাজা রামমোহন রায়ের চরিত্রকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষায় তাঁর অপরিসীম দক্ষতা ছিল। তিনি ধর্ম ও দর্শনতত্ত্বাদির মতো জটিলতর বিষয়বস্তুকে বাংলা গদ্যে আলোচনা করে গদ্যের অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় যে ত্রিশখানি গ্রন্থ লিখেছিলেন তার অধিকাংশই ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন পণ্ডিতের সাথে তর্কের জবাব। রামমোহন রায়ের রচনা সম্ভারের সমস্তকিছুকেই বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করা না হলেও তিনি ছিলেন পরবর্তী যুগে বিকশিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথপ্রদর্শক। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় মাতৃভাষার উপর জোর দিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে সুশৃঙ্খল করার জন্য তিনি রচনা করেন ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ। কোন বাঙালিকর্তৃক রচিত এটিই প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।
রামমোহন রায়ের অন্যান্য অবদান : ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার নানা বৈষম্য নিয়ে তিনি সমালোচনা করেছেন। প্রয়োজনে সরকারকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। চীনের সাথে অবাধ বাণিজ্যের জন্য তিনি আন্দোলন করেছেন। তিনি সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজা রামমোহন রায় বাংলার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা এবং বাঙালি জাতিকে ভালোবেসে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের বাধার প্রাচীর ভেঙে তিনি গতি আনয়ন করেছেন। অগাধ পণ্ডিত্যে, হৃদয়ের উদারতায়, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়, কর্মপরিধির ব্যাপকতায় রামমোহন বাঙালি চিত্তে বিশেষ আসন দখল করে আছেন।