Answer

বাংলায় বিকশিত বিভিন্ন ধারার মরমিবাদ সম্পর্কে যা জান লিখ। লালন শাহের মরমি দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, বাংলায় বিকশিত বিভিন্ন ধারার মরমিবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর। লালন শাহের মরমি দর্শন সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলায় বিকশিত বিভিন্ন ধারার মরমিদর্শন আলোচনা কর। লালন শাহের মরমি দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বিকশিত মরমী ধারার দর্শনতত্ত্ব আলোচনা পূর্বক লালন ফকিরের মরমী দর্শন তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক আকর্ষণেই মানুষ জানতে চায় অজানাকে উন্মোচন করতে চায় তার সৃষ্টিও বৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর অপার রহস্যকে। জানতে বা উপলব্ধি করতে কিংবা একাত্ম বা মিলিত হতে চায় সেই পরম সত্তার সাথে যিনি সৃষ্টি করেছেন এ জগৎ সংসারকে কিন্তু এ উপলব্ধি বা মিলনের উপায় কি? এ প্রশ্নে সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে চিন্তাশীল মানুষের সুসংগঠিত চিন্তার ফসল হিসেবে যে সকল তত্ত্ব বা মতবাদের উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে মরমিবাদ অন্যতম। এই মতবাদে ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা বিচারবুদ্ধি নয়, বরং মরমি অভিজ্ঞতা বা স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় জগৎ, জীবন ও পরমসত্তাকে। এর জন্য দরকার কঠোর, কঠিন ও গভীর অনুশীলন বা সাধনার। বাঙালির জগৎজীবন ভাবনা বা দর্শন চিন্তায় এ মরমিবাদ একটি বিশেষ স্থান লাভ করে আছে।
বাংলায় বিকশিত মরমিবাদের বিভিন্ন ধারা : বাংলাকে বলা হয় আধ্যাত্মিকতা বা মরমি চিন্তা বিকাশের উপর ভূমি কেননা এখানকার সহজ সরল ও আবেগপ্রবণ মানুষের আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকর্ষণ অত্যন্ত বেশি তাই যুগে যুগে এদেশে আগমন ঘটেছে বহু পীর দরবেশ ফকির সুফি তথা মরমি সাধকের বাংলায় বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বাংলায় মানুষের জগৎ ও জীবনভাবনায় তথা জীবনাদর্শে মরমির বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ সময়ে বাংলায় যেসব মরমি চিন্তাদর্শ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় তন্মধ্যে বৈষ্ণববাদ, সুফিবাদ ও বাউলবাদ অন্যতম প্রধান। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
বৈষ্ণববাদ : মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম ও মনন সাধনায় বৈষ্ণববাদ একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বৈষ্ণববাদের মূলবীজ ঋগ্বেদে রোপিত হলেও মধ্যযুগের বাংলায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের হাতেই তা ফুলে ফুলে সুরভিত হয়ে উঠে। বৈষ্ণব মতে মানবসত্তা জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম এ তিনটি বৃত্তি নিয়ে গঠিত। অভাব বা প্রয়োজন থেকে কর্মের সূত্রপাত। কিন্তু ঈশ্বর বা পরমসত্তা পূর্ণাঙ্গ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর কোনো প্রয়োজন বা অভাববোধ নেই বিধায় এ পথে ভাগবৎ সাধনা বৃথা আবার পরমার্থিক জ্ঞান সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত বলে সব মানুষের পক্ষে জ্ঞানের পথে পরমার্থিক সত্তার সন্ধান লাভ সম্ভব নয়।তাই বৈষ্ণব মতে, জ্ঞানে নয়, কর্মে নয় প্রেমভক্তির মাধ্যমেই কেবল সসীম মানুষের পক্ষে পরম ঐশী প্রেম অর্জন ও উপলব্ধি করা সম্ভব। বৈষ্ণব দর্শনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপলব্ধির জন্য ব্যাখ্যাত এ প্রেম কোনো সাধারণ প্রেম নয়, বরং মিস্টিক অভিজ্ঞতাজাত । তাইতো বৈষ্ণব মতে সৎ চিন্তা আনন্দ পরম সত্তার স্বরূপ এবং হ্লাদিনী সন্ধিনী ও সংবিদ তাঁর শক্তি। প্রেমের চূড়ান্ত অবস্থাই ভাব, ভাবের পরাকাষ্ঠাই মহাভাব। ঐশী জ্ঞানের জন্য ব্যাকুল ভক্তরা শান্ত, দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য ভাবের পর্যায় অতিক্রম করে ক্রমশ বিভোর হয়ে যায় নিঃস্বার্থ মধুর মহাভাবও মহাপ্রেম। মহাপ্রেমের মূলকথা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর ভক্ত ও ভগবানের নিকটতম ও নিবিড়তম সম্বন্ধ এবং তাঁর সঙ্গে যুক্ত নির্মল আনন্দ। এই আনন্দঘন অবস্থার অপরোক্ষ প্রতীতির মধ্যেই ভক্ত সাক্ষাৎকার লাভ করেন ভগবানের। বৈষ্ণবের এই অপরোক্ষ প্রতীতি বা মরমি অভিজ্ঞতা আত্ম অভিব্যক্তিমূলক, সম্পূর্ণ অনবদ্য ও অনির্বচনীয়। প্রচলিত সাধারণ ভাষায় এর অবিব্যক্তি অসম্ভব। বৈষ্ণববাদের এই মরমি আদর্শই মধ্যযুগের বাংলায় এক মহাভাব প্লাবন বয়ে দিয়েছিল।
সুফিবাদ : বাঙালির ধ্যান অনুধ্যানমূলক দার্শনিক চিন্তার পরিসরে সুফিবাদ একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ। ইসলামি আদর্শে বিকশিত মরমি দর্শনের এই সুফিবাদী ধারাটি বাংলায় বহিরাগত হলেও বাংলার বিভিন্ন আধ্যাত্মিক মতধারার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে এখানে এক নতুন রূপ লাভ করে। ইসলামি সুফিবাদী ভাবাদর্শের সাথে নিজস্ব চিন্তাধারার সংমিশ্রণে মরমিবাদের যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ধারাটি বাংলায় বিকাশ লাভ করে তা নব্য সুফিবাদ নামে সমধিক পরিচিত। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গূঢ় অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। সুফি সাধকেরা অন্তরের গভীর
অনুভূতির (মরমি) দ্বারা আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। সুফি সাধকেরা এমন এক উচ্চতর জীবনের ইঙ্গিত দেন যেখানে ঐশী প্রেম থেকেই উৎপন্ন হয় উচ্চতর স্বাজ্ঞিক ও অপরোক্ষ গূঢ় জ্ঞান যার নাম মারেফাত। প্রগাঢ় ধ্যানমগ্ন তন্ময়াবস্থায় সুফি এমন এক উচ্চতর আধ্যাত্মিক জ্ঞানালোকের সন্ধান পান, যার সাহায্যে তিনি উপলব্ধি করেন সত্যের মর্মদৃষ্টি তন্ময়াবস্থায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে বিস্তৃত হওয়া এবং বিশেষত আত্মচেতনা হারিয়ে ফেলার অবস্থাকেই সুফিরা বলেন ‘ফানাফিল্লাহ’ এর পরপরই সূচিত হয় ‘বাকাবিল্লাহ’। এ পর্যায়ে সুফির আত্মসত্তা স্থিত হয়। আল্লাহর চেতনায়। এটি সুফির মরমি সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায় এবং এখানে এসেই পূর্ণতা পায় সুফির মরমি সাধনা।
সুফিবাদের এই, আদর্শ নতুন মহীরূহে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বাঙালির ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্য চেতনায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
বাউলবাদ : মধ্যযুগের শেষ অন্তে বাংলার বর্ণ বিভক্ত সমাজ কাঠামোতে একেবারেই নিম্নবর্ণের অধিকার বঞ্চিত ও শোষিত সাধারণ মানুষের জগৎ জীবন সম্পর্কিত বাস্তবমুখী চিন্তাধারায় বিকশিত একান্তই বাঙালির নিজস্ব জীবনধর্মী ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তাধারারই বাউলবাদ নামে পরিচিত। মুসলমান মাধববিবি এবং আউল চাঁদ এ মতবাদের প্রবর্তক এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্র এ মতবাদকে জনপ্রিয় করে তুললেও উনিশ শতকের বাংলায় লালন শাহের সাধনা ও সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাউলবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। বাউল দর্শনে মরমিবাদের উৎকৃষ্ট বিকাশ লক্ষ করা যায় । বাউল দর্শন বাঙালির চিন্তাধারায় বিকশিত এমন একটি মরমি ভাবধারা যা কিছু গুহ্য যোগক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত বাউল ধর্ম ও দর্শন মূলত সাধনাশ্রয়ী দেহই বাউলদের সকল সাধনার মূলভিত্তি। বাউল মতে দেহের মধ্যেই পরম সত্তা বা পরমাত্মার অধিষ্ঠান।তাই মানবদেহই তাঁরা পরমাত্মা বা মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ান অহর্নিশি। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করেন “আপন ভাঙে খুঁজলে পরে সকল জানা যায়,” তাই বাউলরা আপন দেহের সাধনা করার মাধ্যমে পরমাত্মার উপলব্ধি করতে বা সান্নিধ্য লাভ করতে চান। তাঁরা বিশ্বাস করেন মনের মানুষ বা আলেক সাঁইকে জানার উপায় হলো মন দিয়ে উপলব্ধি করা এবং দেহ ও মনের সম্মিলনে চরম অবস্থায় উন্নীত হলেই কেবল এরূপ উপলব্ধির সন্ধান পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ বাউলরা মরমি শক্তির মাধ্যমেই পরমাত্মার উপলব্ধি করেন। বাউল দর্শনের দেহাত্মবাদ গুরুত্ব মনের মানুষ তত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, রূপ স্বরূপতত্ত্ব ইত্যাদিতে মরমিবাদের পরম বিকাশ লক্ষ করা যায়।
লালন শাহের মরমি দর্শন : বাংলার মরমি সাধক ও বাউলকুল শিরোমণি লালন শাহের জন্ম আনুমানিক ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। বাউল ও বাউল দর্শন বলতে আমরা মূলত লালনের জীবনসাধনা ও গানকেই বুঝি। লালন লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা দিয়ে বাউল দর্শনের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি ও মরমি দর্শন চিন্তাবিদ । তিনি তাঁর কবি মন দিয়ে দেহতত্ত্ব আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি জটিল ভাবের গান গেয়ে তাঁর মরমি দর্শন চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন। আমরা জানি আপন হৃদয়ে পরমসত্তাকে অপরোক্ষ অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করার সাধনাই মরমি সাধনা। লালন তাঁর সমগ্র জীবন কর্ম ও গানে এ উপলব্ধিই করতে চেয়েছেন সর্বাত্নকরণে। লালন তাঁর মরমি চিন্তায় মনের মানুষকে (পরম সত্তাকে) খুঁজে ফিরেছেন এবং সে পথ পরিক্রমায় তিনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তবুও তিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন।মনের মানুষ তথা পরমসত্তার সাথে মিলিত হবার একাত্ম হবার এই যে আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা লালনের দর্শনে প্রকাশ পায় তাই তাঁর মরমি আদর্শকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। লালনের দর্শনে মরমিবাদের সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পায় আত্মতত্ত্বে। লালন তাঁর আত্মতত্ত্বে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি। তাঁর মতে মানুষের এসেন্স বা অন্তঃসার তার দেহেই নিহিত। তাই দেহের সাধনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সাধনা করা যায়। দেহের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় পরম স্রষ্টাকে। তাইতো লালন আত্মতত্ত্বের সাধনায় মগ্ন থেকেছেন আজীবন। এ কারণেই তিনি বলেছেন মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে সে কি তত্ত্ব মানে লালন মানবসত্তার মূল তত্ত্বে যাবার প্রেরণাও পেয়েছেন আত্মতত্ত্ব থেকেই। তিনি পার্থিব মানব অভ্যন্তরে কথাই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত গানের নিম্নোক্ত দুটি লাইনে
“এই মানুষেই আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।”
এই মানুষ রতন বা পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনের প্রচেষ্টাই লালনের হৃদয়ানুভূতিকে ব্যাকুল করে তুলেছিল।কেননা তিনি বিশ্বাস করেতেন এ মনের মানুষকে জানলেই নিজকে জানা যায়। পরমসত্তা বা পরম পুরুষকে জানা যায় কিন্তু একে জানা সহজ নয়। তাকে ধরতে গেলে সে ধরা দেয় না তাইতো লালন একে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন অন্তরের আলোকে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় স্বাজ্ঞিক বা মরমি অভিজ্ঞতার আলোকে। আর এখানেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে লালনের মরমি চিন্তাদর্শের মূলসূর।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় মরমি মতাদর্শ বাঙালির ধর্ম দর্শন ও সাহিত্য চিন্তার এক অপরিহার্য অঙ্গ। সহজ, সরল, খোদাভীরু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাঙালির চারণভূমিতে মরমি আদর্শের বপিত বীজে সোনার ফসল ফলিয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচীনকালে বাঙালির মননে আধ্যাত্মিকতা বা মরমি আদর্শের যে স্ফুরণ ঘটে তাই কালক্রমে এদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। বিশেষ করে মধ্যযুগে বৈষ্ণববাদ, সুফিবাদ ও বাউলবাদের হাত ধরে বাংলায় এই মতাদর্শের চরম ও পরম বিকাশ ঘটে ।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!