বাংলাদেশ দর্শন কী? বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর।


অথবা, বাংলাদেশ দর্শন কি? বাঙালি দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দৰ্শন বলতে কী বুঝ? বাঙালি দর্শনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের সংজ্ঞা দাও। বাঙালি দর্শনের উৎস ও বিকাশধারা আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
দর্শন হলো যথার্থ জীবন দর্শন। দর্শনের সাথে মানবজীবনের সবকিছু জড়িত। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অধিবাসীদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতিনীতি, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অবিশ্বাস প্রভৃতির ধারণাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দর্শন বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ দর্শন একধারে বিচারবাদী ও ধর্মীয় প্রভাবান্বিত দর্শন।
বাংলাদেশ দর্শন : ইতিহাস অনসন্ধান করলে দেখা যায়, অন্যান্য অগ্রসর জাতির ন্যায় বাঙালির দর্শন চিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগ। বাংলাদেশ দর্শনের সুদীর্ঘ ইতিহাস জীবনের স্বরূপ ও গূঢ়ার্থ আবিষ্কার এবং যথার্থ মানবোচিত জীবনের অনুসন্ধানসহ মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে। তাই বলা যায়,
বাংলাদেশ দর্শন হলো বাংলাদেশের মানুষের ধ্যানধারণা, চিন্তা, মনন,ভাবধারা, মতামত, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি,সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ। বাংলাদেশ দর্শন নিছক দুঃখবাদী কিংবা ভাববিলাসী দর্শন নয়। সুতরাং বলা যায় যে, প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাংলাদেশ দর্শন।
বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ : বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ কতকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ তিনটি যুগের আলোকে উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছে। যথা : ১. প্রাচীন যুগ, ২. মধ্যযুগ, ৩. আধুনি ও সাম্প্রতিককাল। নিচে এগুলো ব্যাখ্যা করা হলো :
১. প্রাচীন যুগ : ড. সর্বেপল্লী রাধা কৃষ্ণান তার ‘Indian Philisophy’ গ্রন্থে ভারতীয় চিন্তাধারার বিকাশকে চারটি পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন। (ক) বৈদিক যুগ, (খ) মহাকাব্যের যুগ, (গ) সূত্র যুগ, (গ) পাণ্ডিত্যের যুগ। এর মধ্যে বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশের ধারা অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশে অনার্যদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের দৰ্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হতো। এ দর্শনকে জনসাধারণের দর্শন বলেও অভিহিত করা হতো। এখানে ইহলোক, তথা রস্তুবাদী মত বিকশিত হয়। এখানে আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করা হতো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দর্শন যে মতবাদের ভিত্তিতে উদ্ভব ও বিকশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ :
চার্বাক মত : চার্বাক দর্শন নির্বিচারবাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের আবির্ভাব হয় মহাকাব্যের যুগের অন্তবর্তীকালীন করতেন। তারা সবকিছু সময়ে। চার্বাকরা ছিলেন বস্তুবাদী। তারা বৈদিক বিধিবিধানকে প্রচণ্ডরূপে বিরোধিতা বিচার বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলাদেশ দর্শন এ নীতিটিকে গ্রহণ করেছে। প্রত্যাদেশ নির্ভর চিন্তাধারাকে বিনা বিচারে গ্রহণ না করে এ দর্শন এখানে স্বাধীন চিন্তাধারার পথ উন্মুক্ত করে আধুনিক বস্তুবাদের বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা : বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশে অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা প্রবল ভূমিকা রেখেছিল। মহাভারত, বেদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অধ্যাত্মবাদ বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জৈন ও বৌদ্ধ মত : বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশে জৈন ও বৌদ্ধ মতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আত্মার অমরত্বের ধারণা, কিভাবে মোক্ষলাভ করা যায়, জৈন ধর্মের আপেক্ষিকতাবাদ, নীতিতত্ত্ব পরাবিদ্যা, যুক্তিতত্ত্ব এবং বৌদ্ধধর্মের আত্মার ধারণা, নির্বানের ধারণা, মানবতাবাদ নৈতিকতার ধারণা বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে। ফলে বাংলাদেশ দর্শন বিকশিত ও শক্তিশালী হয়েছে।
চর্যাপদ : বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশে চর্যাপদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। চর্যাপদের সত্ত্বা ও অবভাসের ধারণা, চর্যাপদের সাধন তত্ত্ব, ধর্ম সাধনার প্রকৃতি জগৎ ও জীবন ভাবনার নিগূঢ় সংকেত, অধিবিদ্যক ধারণা বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে।
২. মধ্যযুগ : মধ্যযুগে বাংলাদেশে বৈষ্ণববাদ, বাউল তত্ত্ব ও ইসলামি মরমিবাদের বিকাশ ঘটে। নিচে সেগুলো ব্যাখ্যা করা হলো।
বৈষ্ণববাদ : বৈষ্ণববাদ দ্বারা বাংলাদেশ দর্শন চরমভাবে বিকশিত হয়েছে। শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণববাদের প্রতিষ্ঠিাতা ছিলেন। বৈষ্ণববাদীরা বিষ্ণুর উপাসনা করতো। বৈষ্ণববাদের মূলকথা হলো শ্রী কৃষ্ণের গুণকীর্তন করা। এটি করতে হবে প্রেম, ভক্তি ও করুণার মাধ্যমে। অপরের কল্যাণে আপন স্বার্থ ত্যাগ করে বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতির ধারা প্রতিষ্ঠা করা। এটি হলো মানবতাবাদের একটি পর্যায়। এ ধারাটি বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে। ফলে বাংলাদেশ দর্শন মানবাতবাদী দর্শনে পরিণত হয়েছে।
বাউলবাদ : বাউলবাদ থেকে বাংলাদেশ দর্শন সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে। এ দর্শনের মূল কথা হলো মানব দেহেই সব তত্ত্ব ও সত্যের ভিত্তি। দেহই সকল জ্ঞান ও কর্মের উৎস, দেহই কৈলাস বৃন্দাবন, দেহই মক্কা মদিনা। মানবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মা, আলেখ সাই এর অবস্থান। আত্মারূপী পরমেশ্বর বা অধর কালাকে মানবদেহে উপলব্ধি করাই হলো বাউল সাধনার লক্ষ্য। বাউলবাদের গুরু লালন শাহ বলেছিলেন।
“মিলন হবে কতদিনে,
আমার মনের মানুষেরই সনে”
বাউলবাদের এ নীতি বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করে বাংলাদেশ দর্শনকে শক্তিশালী করেছে।
ইসলামি চিন্তাধারা : ইসলামি চিন্তাধারা দ্বারা বাংলাদেশ দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে সুফিবাদ তথা মরমিবাদের ধারণা বাংলাদেশ দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। ১২০৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশ হতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে এ ধারা একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ইসলামি চিন্তার বিভিন্ন বিষয় বাংলাদেশ দর্শনে প্রবেশ করেছে। সুফিবাদের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সাথে একত্ব হওয়া। এটা বাংলাদেশ দর্শনেরও অন্যতম উদ্দেশ্য।
আধুনিক যুগ : বাংলাদেশ দর্শন আধুনিক যুগ দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো। বাংলাদেশ দর্শন সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে বেঙ্গল রেনেসাঁ দ্বারা। বেঙ্গল রেনেসাঁর ফলে অবিভক্ত বাংলার জনসাধারণের সার্বিক জীবনের সবকিছু আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। সমাজে প্রবেশ করে উপযোগ বা মানবাতবাদ, মার্কসবাদ, নিরীক্ষরবাদের ধারণা। বেঙ্গল রেনেসাঁর ফলে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং তার স্থলে যুক্তি চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। এসব চিন্তার ফলে সমাজে মানবতাবাদী একটি শক্তিশালী ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম এ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার মার্কসবাদের প্রভাবে সমাজে বর্ণ বৈষম্য ও শোষণের ধারণা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে সুষম সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। সমাজে ধর্মের প্রভাব কমে যাওয়ার নিরীশ্বরবাদী চিন্তা ও বিকশিত হতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশে একদিকে যেমন চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে তেমনিভাবে রয়েছে সুফিবাদ বৈষ্ণববাদ ও বাউলবাদের প্রভাব। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁ বাংলাদেশ দর্শনকে একটি সত্যিকার দর্শনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। তাই বাংলাদেশ দর্শন এসব উপাদানের নিকট ঋণী।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*