বাংলাদেশে মাঠকর্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মাঠকর্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেমের মাঠকর্মের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মাঠকর্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মাঠকর্ম সমাজকর্মের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। এর মাধ্যমে তারা সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতাকে বাস্তবে সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করে। মাঠকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশে মাঠকর্ম অনুশীলনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা অত্যাবশ্যক। এর ফলে ফলপ্রসূ মাঠকর্ম অনুশীলন সম্ভব হবে। এছাড়া এর রয়েছে ভবিষ্যত সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে মাঠকর্মের সমস্যাসমূহ : নিম্নে বাংলাদেশে মাঠকর্মের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. অর্থের অভাব (Lack of money ) : শিক্ষার্থীরা অর্থের অভাবে অনেক সময় দূরের প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে পারে না। অনেক সময় মাঠকর্মের আনুষঙ্গিক কাজ করতেও অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে তারা সেগুলো ভালোভাবে করতে পারে না।
২. সময়ের অভাব (Lack of time) : মাঠকর্মের জন্য নির্ধারিত সময় ৬০ কর্মদিবস। এ সময়ের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের মাঠকর্ম সম্পাদন করতে হয়। এ সময়ে সমাজকর্মের জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ এবং কয়েকটি কেস স্টাডি করা ছাত্রছাত্রীদের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া তত্ত্বাবধায়কেরাও সময়ের স্বল্পতার কারণে ভালোভাবে তত্ত্বাবধান করতে পারে না।
৩. শারীরিক সমস্যা (Psysical Problem) : অনেক শিক্ষার্থী সমস্যার কারণে ঠিকমত মাঠকর্ম অনুশীলনে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের দেশে অনেক নারী শিক্ষার্থী রয়েছে যারা গর্ভধারণজনিত কারণে মাঠকর্ম অনুশীলন যথাযথভাবে করতে পারে না।
৪. সঠিক তথ্যের অভাব (Lack of proper information) : সাহায্যার্থী সমাজকর্মীকে অনেক সময় ভুল তথ্য প্রদান করে থাকে । এর পিছনে দায়ী হলো তার অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা । ভুল তথ্য প্রদানের ফলে সমাজকর্মীর পক্ষে সমস্যার সমাধান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
৫. সমন্বয় ও যোগাযোগের অভাব (Lack of coordination and communication) : যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে সেবা প্রদান করে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ সংস্থাই সমন্বয় ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। এর ফলে সেবা প্রদান ব্যাহত হয়।
৬. সমাজকর্মের জ্ঞানের স্বল্পতা (Shortage of social work knowledge ) : লক্ষ্যভুক্ত সাহয্যার্থীদের সমাজকর্মের জ্ঞান নেই বললেই চলে। তারা নিজেদের সমস্যা দূর করার জন্যই জোরালো পদক্ষেপ নেয় না । অন্যদিকে,সমাজকর্মীর নিকট সাহায্যার্থীর গ্রহণযোগ্যতাও কম। ফলে মাঠকর্মে ত্রুটি একটি সমস্যা।
৭. পেশাদার তত্ত্বাবধায়কের অভাব (Lack of professional supervisor) : মাঠকর্মের জন্য বরাদ্দ অনেক সংস্থার তত্ত্বাবধায়কে সমাজকর্মের উপর জ্ঞান নেই বললেই চলে না। ফলে তারা মাঠকর্মের উপর ভালো নির্দেশনা দিতে পারে না। এ অবস্থায় মাঠকর্ম চলাকালীন পরামর্শ ও প্রতিবেদন তৈরি শিক্ষার্থীদের জন্য সমস্যা হয়।
৮. সংস্থার স্বল্পতা (Shortage of agency) : শিক্ষার্থীদের মাঠকর্ম সম্পাদনের জন্য সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠানের বড়ই অভাব। অনেক প্রতিষ্ঠানই আবার এ কাজে অংশগ্রহণ করতে চায় না। অনেক সংস্থা থেকে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় সুবিধাও পায় না। ফলে বাংলাদেশে মাঠকর্মের জন্য এটি একটি অন্যতম সমস্যা।
৯. পেশাদার সমাজকর্মীর অপর্যাপ্ততা (Lack of professional social worker) : বাংলাদেশে পেশাদার অভিজ্ঞ সমাজকর্মীর বড়ই অভাব। এজেন্সিগুলোতেও তেমন অভিজ্ঞ সমাজকর্মী নেই। এ অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা (শিক্ষানবিশ সমাজকর্মী) এ পেশায় দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ কম পাচ্ছে। ফলে তারাও শিক্ষা শেষে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে ।
১০. কর্মসূচিগত সমস্যা (Problems of programme) : এদেশে অনেক সংস্থা আছে যেখানে নিজেদের কাঠামো বা কর্মসূচি ত্রুটিপূর্ণ।অর্থাৎ তাদের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়েছে। এসব সংস্থায় ছাত্রছাত্রীরা মাঠকর্ম করতে গিয়ে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে না।
১১. যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাব (Lack of proper supervision) : মাঠকর্মে তত্ত্বাবধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাঠকর্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধান অত্যাবশ্যক। শিক্ষার্থীদের পরামর্শ, উপদেশ ও ভুল সংশোধনের জন্য সৃষ্ট তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান না করার ফলে ছাত্রছাত্রীরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয় ।
১২. সাহায্যার্থীর অসচেতনতা (Uncorciousness of clients) : শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে সাহায্যার্থীদের নিয়ে কাজ করেন । কিন্তু সমাজকর্ম বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। মাঠকর্ম সম্পর্কেও তারা কিছু বুঝে না। ফলে শিক্ষার্থীদের তাদের নিকট থেকে সহযোগিতা নিতে বেশ বেগ পেতে হয়।
১৩. তত্ত্বাবধানমূলক সভার অভাব (Lack of supervisory conference) : মাঠকর্মের চলাকালীন এর অগ্রগতি তত্ত্বাবধায়ক সভার মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হয়। বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক নিজ বিভাগে (কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়) এবং প্রতিষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক নিজ সংস্থায়ও সভা করে থাকে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে প্রায়ই এ সভা বিলম্বে অনুষ্ঠিত হয়।
১৪. চাকরি (Employment) : যারা সমাজকর্ম বিষয়ে পড়াশোনা করে তাদের অনেকেরই পড়াশোনা শেষ হবার আগেই চাকরি হয়ে যায়। আমাদের দেশে চাকরি পাবার পর দীর্ঘ সময়ব্যাপী শিক্ষা ছুটি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে চাকরি ও ছুটির অভাবে অনেকেই মাঠকর্ম অনুশীলন ঠিকমত করতে পারে না।
বাংলাদেশে মাঠকর্মের সম্ভাবনা : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিনিয়ত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বেড়েই চলছে। ফলে মানুষের উন্নতি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। কিন্তু অপরদিকে বিভিন্ন ধরনের সমাজিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব সমস্যাগুলো একটি আর একটির সাথে মিশে জটিল আকার ধারণ করছে। তাই এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত সমাধান ব্যবস্থা যা সমাজকর্মীই কেবল দিতে পারে। সমাজকর্ম ব্যক্তি, দল, সমষ্টিকে এমনভাবে সাহায্য করে যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়।বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এখানে শিক্ষানবিশ সমাজকর্মী বা মাঠকর্মীর কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে মাঠকর্মীরা কাজ করতে পারে সেগুলো হলো- মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার কল্যাণ, হাসপাতাল, সংশোধন কেন্দ্র ইত্যাদি।
বর্তমানে সামাজিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম মাদকাসক্তি। এটি দিন দিন বেড়েই চলছে। এর জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এগুলোকে শিক্ষানবিশ সমাজকর্মী কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে কাজের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর অনেক ছাত্রছাত্রী ঝড়ে পরে। তাদের মানসিক, আর্থিক,সামাজিক সাহায্য করার ক্ষেত্রে মাঠকর্মের সম্ভাবনা অনেক।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠকর্ম দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমূলক কাজ যেমন- শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, মহিলাদের কল্যাণে বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে। মানুষের মৌলিক চাহিদা হলো স্বাস্থ্যসেবা, বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে হাসপাতাল, ডায়াগনিস্টিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার প্রতিবছর হাসপাতাল বৃদ্ধি করছে এসব হাসপাতালে রোগীর সমস্যা সমাধানে কাজ করার জন্য মাঠকর্মীর প্রয়োজন পড়ে। তাই হাসপাতাল সমাজসেবায় মাঠকর্ম অনুশীলনের ব্যাপক সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠান ও NGO দিন দিন বাড়ছে। এগুলোতে মাঠকর্মের প্রয়োজন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মাঠকর্মী বা সমাজকর্মীর কাজের ক্ষেত্র অনেক বেড়েছে এবং কাজের সুযোগও বেড়েছে। তাই এক্ষেত্রে ও সম্ভাবনা ও অনেক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে মাঠকর্ম অনুশীলনে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। তাই এসব সমস্যা সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরদিকে বাংলাদেশে মাঠকর্মের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।বিশেষ করে হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, মানসিক সমস্যা নিরাময় কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংশোধন কেন্দ্র, কল্যাণমূলক কার্যক্রম ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাঠকর্মের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যাশিত উন্নতি করা সম্ভব।এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মনোযোগী হওয়া উচিৎ।