অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের বাধাসমূহ কী কী? এ বাধা দূর করার উপায়গুলো উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার কারণসমূহ কী কী? এ
অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপায়সমূহ আলোকপাত কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ সবিস্তারে বর্ণনা কর। এই প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার উপায়সমূহ লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের জেনারেল সেক্রেটারি হেলোভি মিনিলা মেক্সিকোতে বলেছিলেন, “যদি আমরা সর্বক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার পেতে চাই, তাহলে সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন অধিকসংখ্যক নারীর রাজনীতিতে
যোগদান। কারণ আইনসভা বা সংসদই হচ্ছে আইন প্রণয়নের অধিকারী। আর সে অধিকার আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না লাভ করব, ততক্ষণ অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।” কিন্তু বাংলাদেশের সকল পর্যায়েই নারীর অবস্থান অধস্তন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখ আছে নারীরা পুরুষের মতো সকল ধরনের অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু এটা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি এবং অত্যন্ত কৌশলে পাশ কাটিয়ে নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নানাবিধ কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ : রাজনীতিতে নারীর পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। চিরাচরিতভাবে রাজনীতি একটি একপেশে পেশা ও কর্মক্ষেত্র। রাজনীতিতে পুরুষের
আধিপত্য বা ডোমিন্যান্স রাজনীতিকে একটি পুরুষালী পেশায় পর্যবসিত করেছে। যাইহোক বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিম্নে আলোকপাত করা হলো :
১. পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ : বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সর্বক্ষেত্রে নারীকে অধস্তন ও পুরুষকে প্রাধান্য বিস্তারকারী হিসেবে দেখতে চায়। পিতৃতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে মূল্যবোধ তৈরি হয়, সেখানে নারী হচ্ছে নিকৃষ্ট এবং পুরুষ বিনা নারীর গতি নেই । বিরাজমান মূল্যবোধ তাই নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে রাখে। ফলে মূল্যবোধের দুষ্টচক্রে পাক খেয়ে নারী আরো অধিকার, মর্যাদা, সম্পদ ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। ফলে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ হয়ে পড়েছে প্রশ্নের সম্মুখীন।
২. পারিবারিক কারণ : বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী বিবাহের পর পারিবারিক কাজে লিপ্ত থাকে। পারিবারিক এ দায়িত্ব পালনের পর রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যায় না। তথাপি রাজনীতির কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। এর কর্মক্ষেত্র সমগ্র দেশব্যাপী। একজন কর্মজীবী মহিলার কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং ক্ষেত্র না থাকলে তিনি পুরুষের চেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হন। কারণ মহিলাকে অফিস এবং পারিবারিক দুটি দায়িত্বই পালন করতে হয়। এজন্য আমাদের দেশের নারীরা রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে না।
৩. রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব : আমাদের দেশে মহিলাদের মাঝে রাজনৈতিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সচেতনতার এখনো যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। শুধু অশিক্ষিত নারীই নয়, শিক্ষিত অনেক নারীই রাজনৈতিক বিষয়সমূহ বিশ্লেষণে অপারগ। রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমেই রাজনৈতিক জ্ঞান ও ধ্যানধারণা লাভ করা যায় । অশিক্ষিত হওয়ার কারণে তারা সে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ফলে নারীদের মাঝে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ তেমন কোনো উৎসাহ সৃষ্টি করে না।
৪. পেশিশক্তির অভাব : বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রভাবিত হচ্ছে কালো টাকা ও পেশিশক্তির দ্বারা। এখানে মেধার কোনো মূল্য নেই। যারা বিত্তশালী তারা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে পেশিশক্তির ব্যবহার করছে। কিন্তু মহিলাদের না আছে অর্থ, না আছে অস্ত্রবাজদের ভাড়া করার ক্ষমতা। ফলে পেশিশক্তির অভাবে মহিলারা সঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারে না। এসব পেশিশক্তির কথা ভেবেই অনেক নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণে ভয় পায়।
৫. শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততার হার অতি নগণ্য। দেশের নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে।কুদরত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ নারী কুসংস্কার ও অজ্ঞতাকে পাথেয় করে সংসার জীবন নির্বাহ করেন। অনতিবিলম্বে এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।” নারীদের মাঝে শিক্ষার স্বল্পতার কারণেই তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণে সংকুচিত হয়।
৬. নিরাপত্তার অভাব : বাংলাদেশের ঘরে ও বাইরে নারীদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার উপর রাজনীতি।ব্যাপারটি এখানে অনেক জটিল। এখানে নারীর নিরাপত্তার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই বলে আমাদের দেশের নারীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে না।
৭. ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য : আমাদের দেশের লোকজন এমনিতেই ধর্মভীরু। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের কারণে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না। এক্ষেত্রে ফতোয়াবাজরা বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে নারীদেরকে দমন করার চেষ্টা করে। আর নারীরা ধর্মভীরু বলে সেটা মেনেও নেয়। এমনকি ফতোয়ার মাধ্যমে নারীদেরকে ভোটদানেও বাধা দেয়া হয়। ফলে নারীরা রাজনীতিতে স্বাধীনভাবে এ চক্রের শক্তিশালী সাংগঠনিক অবয়ব ভেদ করে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
৮. নারীসমাজের অনীহা : বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা নারীসমাজ রাজনীতির মতো।একটি প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী হয় না। প্রখ্যাত নারীবাদী এমাগোল্ড ম্যানের মতোই বলতে হয়, “রক্ষণশীল এ সমতা কাঠামোর মধ্যে থাকতে থাকতে নারী হয়ে উঠে ক্ষুদ্রমনা এবং কোনোকিছুতেই আগ্রহবোধ করে না।” এরূপ একটি ব্যবস্থার মধ্য থেকেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নারীদের অনীহার সৃষ্টি হয়।
৯. পুরুষ কর্তৃক নিরুৎসাহ প্রদান : নারীদেরকে রাজনৈতিক স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্তকরণে পুরুষদের ভূমিকা ইতিবাচক না হয়ে বরং নেতিবাচকই হয়ে থাকে। নারীর রাজনীতিতে প্রবেশাধিকারকে তারা সুনজরে দেখে না। ফলে নারীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহ পায় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, আজ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে একাত্মতা ঘোষণার প্রয়োজনে এবং দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে নারীমুক্তির লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বলেছিলেন, “আমরা সমাজের অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? অকর্মণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্টি হই নাই।” আজ তাঁর সেই গভীর আত্মোপলব্ধি আমাদের হৃদয়কেও স্পর্শ করেছে এবং সময়ের প্রয়োজনে পুরুষের পাশাপাশি ও সমগতিতে পথ চলার তাগিদটি অতি স্পষ্ট।
Leave a Reply