বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থান মূল্যায়ন কর।

অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের প্রকৃতি ও অবস্থান ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের প্রকৃতি ও অবস্থান বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সার্বিকভাবে রাজনীতিতে নারীরা সংখ্যালঘু। শাহীন রহমান তাঁর ‘জেন্ডার প্রসঙ্গ’ বইয়ে বলেছেন, “বিশ্বের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র পাঁচ থেকে দশ ভাগ।” যদিও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়েই নারী, যা বিশ্বে বিরল। কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে দু’ নেত্রীর প্রাধান্য ও প্রচণ্ড দৃশ্যমানতার পাশাপাশি বিরাজ করছে প্রায় নারী শূন্যতা। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় সর্বস্তরে বিশেষ করে কাঠামোগত রাজনীতিতে নারীর অবস্থান মোটেই ব্যাপক, সুসংগঠিত বা সুসংহত নয়। এর পিছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিরন্ধকতা, যা রাজনীতিতে নারীকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে।
রাজনীতি : রাজনীতির মূলকথা হলো ক্ষমতার চর্চা করা। F. Burlatsky রাজনীতিকে দেখেছেন বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও জাতির মধ্যকার ক্ষমতার সম্পর্কের ভিত্তিতে। রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক ক্ষমতা কোনো শ্রেণির সংগঠিত ক্ষমতা। এ ক্ষমতার সাহায্যে সে শ্রেণি অন্য কোনো শ্রেণিকে শোষণ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান : আদর্শগতভাবে বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকা নির্ধারিত হয় পরিবারে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধারণা অনুযায়ী নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রকৃতিগতভাবে কমযোগ্য। তাই তাদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকবে পারিবারিক পরিসরে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকাকে গৌণ করে দেখা হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এ প্রান্তিকতা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নারীদেরকে পশ্চাৎপদ করেছে। ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে উল্লেখ আছে, নারীরা পুরুষের মতো সবধরনের অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু এটা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি এবং অত্যন্ত কৌশলে পাশ কাটিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে নারীকে পর্দার অন্তরালে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শুধু রাজনীতিতে আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং Civilization কেই বুঝায় না। এর কর্মকাণ্ডের পরিধি আরো ব্যাপক। তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করাকেই বুঝায়। সাধারণভাবে ভোটদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকেই রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বুঝায়। উপর্যুক্ত পর্যায়গুলো ছাড়া আরো কিছু পর্যায় দ্বারা রাজনীতিতে নারী বাধার সম্মুখীন হয়। এসব বাধার আলোকে রাজনীতিতে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান কিরূপ নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক দলে নারী : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, প্রধান দু’ দলের নেত্রী মহিলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোতে মহিলা সদস্য নেই বললেই চলে। নিম্নের ছকটির দিকে তাকালে দেখা যাবে মহিলাদের অবস্থান রাজনৈতিক দলগুলোতে কিরূপ। এখানে মোট সদস্যের সাথে নারী সদস্যের তুলনা করলে দেখা যায়,
নারীরা রাজনীতিতে শুধু পিছিয়েই নেই, রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। আর জামায়াতে ইসলামের কমিটিতে নারী সদস্য নেয়াই হয় না।
২. জাতীয় সংসদে সাধারণ আসন : বাংলাদেশের আইনসভা বা জাতীয় সংসদ একক ভৌগোলিক নির্বাচনী এলাক থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ আসনের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথম সংসদ থেকে সপ্তম সংসদ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনে মোট ১৬৬ জন মহিলা সদস্য মনোনীত হয়েছেন। ২০০১ সালে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এদের মধ্যে একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছে ৮ জন। ৭ম জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সাংসদ রয়েছেন ৭ জন। ১৯৯১ এর সরাসরি নির্বাচিত নারী ছিলেন ৫ জন। ২০০১ সালে সরাসরি নির্বাচিত নারী ছিলেন ৬ জন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮ এ সাধারণ আসনে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ১৯ জন নারী সংসদ নির্বাচিত হন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ এ সাধারণ আসন থেকে ২৮ জন নারী সদস্য নির্বাচিত হন।
৩. জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন : ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ১৫টি আসন সংবিধান প্রবর্তনের সময় থেকে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখে। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ দশম সংশোধনীর মাধ্যমে এ সংখ্যা ৩০এ উন্নীত হয়। পরবর্তীতে আরেক দফা সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ বেড়েছে যা ২০০১ সাল পর্যন্ত কার্যকরী হয়েছে। ২০০১ সালে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দাবি সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ৬৪টি করা হোক। উইমেন ফর উইমেনও অনুরূপ মতো ব্যক্ত করেন। নারীপক্ষ সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নে মহিলা কোটা আরোপের সুপারিশ করেছে। ২০০৪ সালে নারীদের জন্য ৪৫টি সংরক্ষিত আসন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরো ৫টি সংরক্ষিত মহিলা আসন বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ বর্তমান দশম সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থীরা সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন বলে তারা নিজেদেরকে দেশের নারীসমাজের কাছে তেমন দায়বদ্ধ করেন না।
৪. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে : রাজনীতিতে সাংগঠনিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের জন্য যে ধরনের সময়, সুযোগ, গতিশীলতা, যোগসূত্র ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন তা এদেশের নারীদের নেই। আর যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেছেন তাদের অধিকাংশই এসেছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। নিম্নের সারণিতে জাতীয় সংসদে বিজয়ী মহিলা সদস্যদের শতকরা হার দেয়া হলো :
৫. মন্ত্রিসভায় নারী : বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় নারীদের অবস্থান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাধারণত গুরুত্বহীন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে মহিলা মন্ত্রীদের নিয়োগ করা হয়। যেমন- সমাজকল্যাণ, মহিলা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, কো-অপারেটিভ ও স্থানীয় সরকার ইত্যাদি মেয়েলি বিষয়ে তারা নিয়োজিত হন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে
মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা কিরূপ ছিল নিম্নের ছকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে :
৬. ইউনিয়ন পরিষদে নারী : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বনিম্ন প্রশাসনিক স্তর স্থানীয় সরকার, যার মূলভিত্তি ইউনিয়ন পরিষদে নারী ও পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ ও সঠিক প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রবর্তিত নতুন আইন (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭)। এতে নারীদের ৩টি (এক- তৃতীয়াংশ) সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে নারীর ক্ষমতায়নে এটি একটি বিরাট অর্জন। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনেই প্রথম মহিলারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সুতরাং নারীর ক্ষমতায়নে এটি একটি বিরাট পদক্ষেপ। তবে বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব সদস্যের ভূমিকা
কার্যকরভাবে বৃদ্ধি পায়নি। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অবস্থান প্রান্তিক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের ভূমিকা খুবই নগণ্য। তবুও একথা সত্যি যে, ইদানীং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভাবনাময় এ প্রেক্ষাপট নারীর ক্ষমতা ও রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের প্রশ্নে কলাকৌশল উদ্ভাবন ও প্রয়োগের সক্রিয় চিন্তাভাবনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। তবে একথা সত্য যে, পুরুষরা যদি নারীদেরকে সহযোগিতা না করে এবং সর্বোপরি নারীদের সচেতনতা যদি বৃদ্ধি করা না যায় তবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কখনই সম্ভব নয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*