বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপনের প্রক্রিয়া আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিক পৃথিবীতে ‘গণমাধ্যম’ আমাদের দৈনিক বাস্তবতার অংশ। সংবাদপত্র, সাময়িকী, বই, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও বা ইন্টারনেট যত ধরনের গণমাধ্যম আছে, আমরা কেউ তার আওতার বাইরে নই। আধুনি সভ্যতার সবচেয়ে অন্যতম বিস্ময়কর এবং সবচেয়ে পরিবর্তনশীল কর্ম এলাকা এ ‘গণমাধ্যম’। গণমাধ্যম ছাড়া উন্নত
কিংবা উন্নয়নশীল যে কোন দেশেই নাগরিক জীবনে গুরুতর ছন্দপতন ঘটে। পাশাপাশি গণমাধ্যমেই উপস্থাপিত হয় সমাজজীবনের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। সে জন্যই বলা হয়, গণমাধ্যম শুধু বাস্তবতাকে ব্যাখ্যাই করে না, সৃষ্টিও করে জোসেফ টি ক্ল্যাপারের মতে, “মিডিয়া বা গণমাধ্যম প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখে।” আমাদের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা হল পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শই সমাজে প্রাধান্যশীল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত মতাদর্শ হল নারীর তুলনায় পুরুষ শ্রেষ্ঠ শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিভাবে। তাই নারী-পুরুষের অধস্তন এবং এ অধস্তনতা সমাজে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। গণমাধ্যম যেহেতু সমাজেরই অংশ, তাই গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নারীর অধস্তনতা চিত্রায়িত হতে থাকে এবং পুরুষ যেভাবে দেখতে চায় সেভাবেই গণমাধ্যমে নারীকে তুলে ধরা হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় : আমাদের দেশে প্রচলিত প্রধান গণমাধ্যমগুলো হচ্ছে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি। গণমাধ্যমে নারীর যে চিত্র দেখা যায় তা নারীর
জন্য অবমাননাকর এবং সেটা তার অধস্তনতাকে নির্দেশ করে। পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শই প্রতিফলিত হয়। যদিও বর্তমানে কিছু কিছু গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয় কিন্তু এটা পরিমাণে খুব নগণ্য। গণমাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা নারীর নেতিবাচক উপস্থাপনই দেখে থাকি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রধান গণমাধ্যমে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় তা নিচে আলোচনা করা হল :
সংবাদপত্রে নারী : গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় সংবাদপত্রের মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা থাকে নারীদের জন্য। প্রথম পাতায় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের পাশে নারীদের সংবাদ থাকে খুব কমই। নারী বিষয়ক যেসব আইটেম কাগজে ছাপা হয়, তাতে আবার একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে নারীর ছবি। সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ানোর জন্য নারীর ছবিকে
প্রাধান্য দেওয়া হয়। সংবাদপত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল মুনাফা অর্জন ও মালিক শ্রেণীর স্বার্থ বজায় রাখা। আর সে জন্য সংবাদপত্র এমনকিছু পরিবেশন করবে না, যা পাঠকের অপছন্দ হবে বা তার মনে বিরূপ ধারণার জন্ম দেবে। অর্থাৎ উপস্থাপনা হবে ‘Selective’ এবং ‘Schematic’ এবং সেসব চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা পাঠকের
মানসিকতায় বিরাজমান। মহিলা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী তাই অধিকাংশ পত্রিকাতেই মানুষের পর্যায়ে পৌছতে পারেন না, থেকে যান ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে। পত্রিকার ভাষায় দেশ ও সমাজ রূপান্তরিত হয় দুই নেত্রীর ‘সংসারে’। আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলোতে নারীকে যেভাবে তুলে ধরা হয় তার কতকগুলো রূপ নিম্নে দেওয়া হল ঃ
১. নির্যাতিত হিসেবে নারী : সংবাদপত্রের পাতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিত হিসেবে নারীদের দেখে থাকি সমাজে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার প্রতিফলন ঘটছে মূলত জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর মাধ্যমে। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক উভয়ই আছে। বর্তমানে নির্যাতনের খবরগুলো গুরুত্বসহকারে ছাপার ফলে সমাজে নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে
এক ধরনের ধিক্কার সৃষ্টি হচ্ছে এবং কখনও কখনও তার ভিত্তিতে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠছে। এছাড়া সংবাদপত্রে অপরাধীর বদলে নির্যাতিত নারীর ছবি ও পরিচয় প্রকাশের কারণে নির্যাতিত নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যান্য খবরের চেয়ে নির্যাতনের খবর বেশি প্রকাশিত হওয়ায় পাঠকদের এ মানসিক ধারণা হয় যে, নারীদের নির্যাতন করাই যায়,
তাদের জন্মই নির্যাতিত হওয়ার জন্য। তাই সংবাদপত্রে নির্যাতিতা হিসেবেই নারীদের বেশি দেখা যায়।
২. অসহায় ও দুর্বল হিসেবে নারী : বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে নারীদের ছবিই প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে নারীদের দুর্বল ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া এসব দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে অসহায় নারীদের ছবিই সংবাদপত্রগুলোতে দেখা যায়। এর অতিরিক্ত কিছু আছে যা রুচির
আওতায় পড়ে না।
৩. আদর্শ ও সুন্দরী নারী : বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদপত্রে নারীদের জন্য আলাদা পাতা থাকে এটাকে বলে।‘নারীপাতা’। এ নারীপাতায় নারীর সনাতনী ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই দেখা যায়, এসব পাতার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকে রান্নাবান্না এবং ঘর সাজানোর কথা। এছাড়া থাকে নারীদের সাজুগুজু এবং রূপচর্চার কথা। আর পত্রিকার
সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য থাকে সুন্দর সুন্দর নারী মডেল এর ছবি। নারীর সৌন্দর্যকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে। রমণীয়, কমনীয়, স্নেহশীল আদর্শ নারীর চিত্রও এখানে দেখা যায়। তবে বর্তমানে কিছু কিছু পত্রিকায় নারী অধিকার, নারী আন্দোলন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা হয়। যেমন- দৈনিক প্রথম আলোর নারী মঞ্চ পাতা।
৪. খেলার পাতায় নারী : খেলার পাতায় নারীদের খবর থাকে খুব কম। নারী খেলোয়াড়দের খেলার খবরের চেয়ে তাদের মোহময়ী ভঙ্গির ছবি প্রকাশ করার দিকে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। যেমন- সানিয়া মির্জা, শারাপোভা, আনা কুর্নিকোভার মত গ্লামারাস খেলোয়াড়দের ছবিই সংবাদপত্রে বেশি দেখা যায়। তাদের সৌন্দর্যকে এখানে পুঁজি করা হয়।
পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য।
৫. পত্রিকার বিজ্ঞাপনে নারী: সংবাদ হিসেবে নারীকে সংবাদপত্রের পাতায় বেশি দেখা না গেলেও পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীর ছবি দেখা যায়। এখানেও সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয় পণ্যের প্রচারের জন্য। নারী হয়
সৌন্দর্য সর্বস্ব। গণমাধ্যম হিসেবে রেডিওতে নারীকে উপস্থাপন : রেডিওতে প্রচারিত মহিলাদের অধিকাংশ অনুষ্ঠান পত্রিকার মহিলা পাতার বিষয়বস্তুর কার্বন কপি। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিওতে নারীদের নিয়ে সাধারণত যেসব অনুষ্ঠান হয় তার মধ্যে রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক অনুষ্ঠান। রেডিওতে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক অনুষ্ঠানে মুখ্য ভূমিকা থাকে নারীর। কেননা নারীকে সহজেই জন্মশাসন পদ্ধতির ভোক্তায় পরিণত করা যায়। পরিবার পরিকল্পনা বিজ্ঞাপনের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। বার বার পরিবার পরিকল্পনা বিজ্ঞাপন মনে করিয়ে দেয় যে, জন্মদান ব্যতীত নারীর দ্বিতীয কোন ভূমিকা প্রায় নেই-ই। নারীকে সমাজ রূপান্তরের কর্মে ভূমিকা রাখতে হবে এই সত্য নারীদের জন্য বরাদ্দ সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানেও উচ্চারিত হয় না।
টেলিভিশনে নারীর চিত্রায়ন : টেলিভিশন বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশীল গণমাধ্যমে এবং এর ব্যবহারকারী পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি। আর অডিও ভিস্যুয়াল মিডিয়া হওয়ার কারণে এতে নারীকে সৌন্দর্য ও যৌনতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার সম্ভাবনা থাকে কারণ সমাজও নারীকে সেভাবে দেখে। ঘটনা ঘটেও সে রকম। টেলিভিশনের সংবাদ, নাটক, টেলিফিল্ম সোপ অপেরা, টক শো, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নারীকে সৌন্দর্য ও যৌনতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে টিভিতে নারীর সৌন্দর্যকেও বেশি দেখানো হয় যৌনতার চেয়ে। টিভিতে আমরা নারীকে যেভাবে দেখি তার কয়েকটি চিত্র নিম্নে দেওয়া হল :
১. সনাতন বা গতানুগতিক ভূমিকায় নারী : নারীর প্রধান কাজ সন্তান লালনপালন, ঘর গৃহস্থালির দেখাশোনা নারীর এ চিরন্তন ভূমিকাকে টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমে বেশকিছুই পরিবারকেন্দ্রিক। আর মহিলাদের জন্য নির্ধারিত অনুষ্ঠান রূপচর্চা রান্নাবান্না, শিশু পরিচর্যা, ঘর সাজানো ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
২. সুন্দর নারী : বর্তমান নাটকগুলোতে বেশিরভাগ নারীর ভূমিকা হয় প্রেমিকার। পুরুষের প্রশংসা ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই যাদের জন্ম। কেবল সৌন্দর্যই এদের গুণাগুণ বলে বিবেচ্য। শুধু নাটক নয়, সব অনুষ্ঠানে সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
৩. শোভাবর্ধক : টক শো কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানগুলোতে নারীদের প্রাধান্য নেই, তারা থাকে উপস্থাপকে সহকারী হিসেবে। এখানে তার অবস্থান শোভাবর্ধকের।
৪. মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে : বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নারীর কিছু গৎবাঁধা প্রতিমা কাজ করছে। যেমন- ধনাঢ্য ঘরের মেয়ে মানেই সে হবে হাতকাটা ব্লাউজ পরা, উচ্ছৃঙ্খল, খেয়ালি। মধ্যবিত্ত ঘরের মায়েরা হবেন সন্তান অন্তপ্রাণ, সহজ, সরল শান্তিবাদী। গ্রামীণ তরুণী সে হবে অবশ্যই আত্মমর্যাদাহীন
ভালোবাসায় সমর্পিত এবং সতীত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। নারীদের এসব চিত্রে বাস্তবতার সাথে কোন মিল নেই। দরিদ্র নারীদের কথা টেলিভিশন নাটকে খুব কমই উঠে আসে।
৫. সংবাদ পাঠিকা হিসেবে নারী : সংবাদ পাঠিকা হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। আবার রিপোর্টিং এর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পুরুষদের বেশি দেখা যায়। এটা প্রমাণ করে যে, টেলিভিশন সংবাদ বিভাগে নারীর সৌন্দর্যকে মূল্য দেওয়া হয়। আর রিপোর্টিং মেয়েদের কাজ নয় এ ভাবনার বশবর্তী হয়ে নারীদের রিপোর্টিং এ আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
টিভি বিজ্ঞাপনে নারী : ‘Woman’s body sales’ এ গূঢ় তথ্য যেদিন থেকে আমেরিকান বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞগণ বুঝতে পেরেছেন সেদিন থেকে শুরু হয়েছে পণ্য বিক্রির মাধ্যম হিসেবে নারী মুখ ও নারী দেহকে যতটুকু সম্ভব নগ্নভাবে ‘Exploit’ করা। আমাদের দেশের টিভি বিজ্ঞাপনগুলো নারীর স্টেরিওটাইপ ইমেজ তুলে ধরতে তৎপর। কর্তব্যপরায়ণ মা,
সুচারু গৃহিণী এবং সুসজ্জিতা, সুদর্শনা, প্রেমময়ী স্ত্রী ভোগবাদী সমাজের এ নারীরূপ টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বার বার প্রতিফলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করছে।
চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীর উপস্থাপন : অন্য শিল্পমাধ্যমগুলোর তুলনায় চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। অবশ্য একে ‘উপস্থিতি’ না বলে ‘উপস্থাপিত’ বলাই সঙ্গত। চলচ্চিত্র শিল্পে নারী উপভোগের বা ভোগের উপাদান। পুরুষাধিপত্যের এ পৃথিবীতে নারী যেমন রাজনীতি, শিল্প কিংবা অর্থনীতির কেন্দ্রভাগে নেই, তেমনি নেই চলচ্চিত্রেও চলচ্চিত্রে নারী পুরুষের চোখে দেখা অপর লিঙ্গমাত্র পুরুষের জন্য নারী কি অর্থ বহন করে তাই মূলত চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারীকে সাধারণত যেভাবে তুলে ধরা হয় তা আলোচনা করা হল :
১.নিষ্ক্রিয় : চলচ্চিত্রে পুরুষ চরিত্র সবসময় সক্রিয় এবং ক্ষমতাবান থাকে যাকে কেন্দ্র করে সকল নাটকীয় ঘটনা উন্মোচিত ও পরিণত হয়। অন্যদিকে, নারী চরিত্র সবসময়ই নিষ্ক্রিয় ও ক্ষমতাহীন পুরুষ চরিত্রগুলোর কামনার বস্তুমাত্র।
২. যৌন উদ্দীপক : চলচ্চিত্র নারীকে শুধু নিষ্ক্রিয় ও নিখুঁত সৌন্দর্যের আঁধার হিসেবেই পুনঃনির্মাণ করে না, যৌন উদ্দীপক উপাদান হিসেবেও উপস্থাপন করে। নারীকে এমন সব পোশাক পরানো হয় এবং এমন ভাবভঙ্গি করতে বাধ্য করা হয়, যা যৌন আবেদন সৃষ্টি করে। পর্দায় নারীর আবেদনময়ী উদ্দীপক শরীরীরূপ উপভোগ হলো পুরুষের যৌন কামনা
নিবৃত্তির আরেক বিকৃত উপায়।
৩. পতিব্রতা স্ত্রী : অধিকাংশ চলচ্চিত্রে নারীকে পতিব্রতা নারী হিসেবে দেখানো হয়। যার একমাত্র কাজ হল লম্পট স্বামীকে ভালো পথে আনা, নানা কলাকৌশলে স্বামীকে ঘরে ফিরিয়ে এনে তার সেবায় আত্মোৎসর্গ করা।
৪. প্রেমিকা : চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীর প্রেমিকা রূপটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ প্রেমিক নায়িকার কাজ হল যে কোনভাবে নায়ককে প্রেমের ফাঁদে ফেলা এবং তার মনোযোগ আকর্ষণ করা। তারপর নায়কের সাথে নাচগান করা এবং প্রতি মিনিটে পোশাক বদলানো। নায়ক-নায়িকা উভয়েই পোশাক বদলায়। তবে নায়িকার পোশাক বদলানোই ফোকাস করা হয়।
৫. পেশাহীন : অধিকাংশ চলচ্চিত্রে নারীদের কোন পেশা দেখানো হয় না। নারীদের অংশগ্রহণ থাকে মা, বোন এবং প্রেমিকা হিসেবে। তবে দু’একটি সিনেমায় নায়িকাকে উকিল কিংবা পুলিশের ভূমিকায় দেখা যায়। তবে এটা দেখা যায় কম সংখ্যক চলচ্চিত্রে।
৬. ধর্ষিতা নারী : বাংলাদেশের মূলধারার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই কয়েকটি করে ধর্ষণের দৃশ্য থাকে। দেখা যায়, নায়কের বোন বা অন্য কেউ ধর্ষিত হলে সে আত্মহত্যা করে। এতে সমাজে ধর্ষিতা নারীদের আত্মহত্যা করার দিকে উৎসাহিত করা হয় । নায়িকা কখনও ধর্ষণের শিকার হয় না তাকে সবসময় নায়ক উদ্ধার করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় তা আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম। আলোচনা থেকে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়। তবে সমাজে নারীর যে বৈষম্যমূলক অবস্থান তার জন্য গণমাধ্যম একা দায়ী নয় এবং গণমাধ্যমই শুধু নারীর
নেতিবাচক ইমেজ প্রতিষ্ঠা করে না। গণমাধ্যম ও নারীর মধ্যকার নেতিবাচক সম্পর্কের জন্য দায়ী আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক মতাদর্শ, যা আমাদের শৈশব থেকে শিখানো হয় পরিবারে, প্রথা-সংস্কৃতি-ধর্ম-আইন দিয়ে যাকে জোরদার করা হয়। গণমাধ্যম এ জেন্ডার বৈষম্য জোরদার করতে বা নারীর নেতিবাচক ভূমিকাকে যেমন তুলে ধরতে পারে,
তেমনি নারীর ইতিবাচক দিকও তুলে ধরতে পারে এবং জেন্ডার সমতার মূল্যবোধও শিখাতে পারে। গণমাধ্যম তো জনগণের মাধ্যম অর্থাৎ আমাদের সকলের মাধ্যম তাই আমাদেরকেই সক্রিয় হতে হবে গণমাধ্যমে নারীকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার জন্য।