অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল প্রত্যয়গুলো বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল কারণগুলো সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : উনিশ শতকে প্রথমে পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল নতুন ধরনের সমাজব্যবস্থার পরে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলার নারী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। বাংলার নারী আন্দোলনের সূচনা হয়েছে সমাজ আলোকে গড়ে উঠা রাজনৈতিক বিল্পব, শিল্পবিল্পব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তারই প্রত্যক্ষ ফলাফলে সৃষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রীয় এক শতাব্দী সচেতনতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা এ দুই ধারার সমন্বয়ে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও পুরুষ শাসিত এ সমাজ পুরুষের মতো নারীদের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে নারাজ। নারীদের প্রতি যে অন্যায় ও বৈষম্য রয়েছে তা এদেশের নারী সমাজ উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং সে অন্যায় ও বৈষম্য মেনে না নেয়ার মধ্যে দিয়েই নারী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে। আর এ আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছে কিছু প্রত্যয়ের উপর ভিত্তি করে। যা আমাদের এখনকার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।
নারী আন্দোলনের মূল প্রত্যয় : সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে সমাজের চেহারাও। নারীসমাজ তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছে। নারীরা আজ আন্দোলনে নেমেছে সকল ক্ষেত্রে তাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের যারা পথিকৃৎ তাঁদের বক্তব্যের পরম্পরায় নারী আন্দোলনের মূল প্রত্যয় বেরিয়ে এসেছে। (১৯৭০-২০০০) বেইজিং বিশ্ব নারীসম্মেলন হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমানে নারী আন্দোলনের প্রধানত দুটি প্রত্যয় রয়েছে বাংলাদেশে । যথা :
ক. Uniform code of law.
খ. CEDAW এর প্রতিটি ধারাকে রাষ্ট্র কর্তৃক গ্রহণ করা। উপর্যুক্ত প্রত্যয় ব্যতীত বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের চিহ্নিত যেসব প্রত্যয় রয়েছে সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
ক. পারিবারিক :
১. পিতৃপ্রধান পরিবার ও পরিবারে নারীর অসম অবস্থান।
২. পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও সম্পদে নারীর নিয়ন্ত্রণের অধিকারহীনতা।
৩.বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন।
৪.বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ।
৫.যৌতুক প্রথা চালু থাকা।
৬.নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
খ. শিক্ষাক্ষেত্রে :
১. নারী স্বাক্ষরতার নিম্নহার এবং অব্যাহত নারী পুরুষ বৈষম্য।
২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর অনগ্রসরতা।
৩. নারী শিক্ষার লক্ষ্যে উন্নয়ন পকিল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব।
৪. তথ্য ও গবেষণা কেন্দ্রের অভাব।
গ. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে :
১. নারীর দারিদ্র্য।
২. নারীর কম মজুরি।
৩. নারী পাচার, নারীর জবরদস্তিমূলক পতিতাবৃত্তি।
৪. শ্রমবাজারে নারীর সীমিত প্রবেশাধিকার।
৫. ঋণ ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে নারী উদ্যোক্তার টিকে থাকার সমস্যা।
৬. ট্রেড ইউনিয়নে নারীর সীমিত প্রবেশাধিকার।
৭. নারীর কৃষিকাজে যে অবদান তার স্বীকৃতি না দেয়া।
৮. সম্পদে নারীর সমঅধিকার না থাকা।
৯. শ্রমজীবী ও কর্মজীবী নারীদের শিশু রক্ষণাবেক্ষণে অব্যবস্থা।
১০. পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য, অল্প মজুরি ও চাকরির অনিশ্চয়তা।
ঘ. স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা :
১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বৈষম্য।
২. নারীকে একতরফাভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের চাপ প্রয়োগ।
৩. গর্ভবতী ও সন্তান দানকারী মায়ের চাহিদা অপূর্ণ থাকা।
৪. ধর্মীয় কুসংস্কার।
৫. পুষ্টিহীনতা।
ঙ. নারীনির্যাতন ও মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যা :
১. নারীনির্যাতন বিরোধী আইনের ত্রুটি ।
২. সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর অধস্তন অবস্থান।
৩.সকল সম্প্রদায়ের প্রচলিত বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনের অনুশাসন। যা সংবিধানে ঘোষিত নারী পুরুষের আইনগত সমঅধিকারের বিরোধী।
৪. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, বিশেষত পুলিশ প্রশাসনে নারীনির্যাতন বিষয়ে উদাসীনতা ও পুলিশ কর্তৃক নারীনির্যাতন।
৫. আইনের শাসনের অবমাননা করে ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যাখ্যা ও প্রয়োগ এবং নারীকে ফতোয়ার শিকার করে নির্যাতন করা।
৬. সমাজে নারীর নিরাপত্তার অভাব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদেরকে যে বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত ও অধস্তন করে রাখা হয়েছে তার প্রতিবাদের ভাষাগুলোই হচ্ছে নারী আন্দোলনের ইস্যু। নারীরা আজ আর তাদের প্রতি উপেক্ষা ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে রাজি নয়। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। আর তাদের এ সচেতনতা থেকে উদ্ভূত প্রতিবাদই হয়তো তাদেরকে একদিন সফলতার দ্বারে পৌছে দিবে।
Leave a Reply