বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে যে নারীদের জন্য বিশেষ ‘নারীপাতা’ বের হয়, এটা কি নারী উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে?

অথবা, বাংলাদেশের দৈনিক সংবদপত্রগুলোতে নারীদের জন্য ‘নারীপাতা’ বের হয়, এটা নারী উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা পালন করে থাকে? আলোচনা কর।
অথবা, নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রের নারীপাতার ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের পরও সংবাদপত্র তার স্বমহিমায় টিকে আছে। বাংলাদেশের মত দেশে সংবাদপত্রই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী গণমাধ্যম। কিন্তু এ প্রভাবশালী গণমাধ্যম কি
নারী উন্নয়নের জন্য কোন ভূমিকা পালন করছে, বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে বর্তমানে নারীদের জন্য বিশেষ ‘নারীপাতা’ বের করা হয়। এ ‘নারীপাতা’ কি নারী উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
নারীদের জন্য ‘নারীপাতা’ : বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে নারীদের জন্য বিশেষ ‘নারীপাতা’ বের হয়। তবে এ নারীপাতা দু’ধরনের। যথা : প্রথম আলোতে সপ্তাহে ২ দিন নারীদের জন্য বিশেষ পাতা বের হয়। একটা মঙ্গলবারে, এটা হল ‘নকশা’- এখানে নারীদের রূপচর্চা, রান্নাবান্না, ঘর গৃহস্থালির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া
হয়। আরেকটি হল, ‘নারীমঞ্চ’ এখানে নারীদের অধিকার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, নারীদের সংগ্রাম, নারী আন্দোলন, বিখ্যাত নারীদের জীবন ইতিহাস ইত্যাদি দেওয়া হয়। প্রায় সব দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে সপ্তাহে ২দিন নারীদের জন্য এ রকম দু’টি পাতা দেওয়া হয়। এ পাতাগুলো একদিকে যেমন— ‘নকশার মত পাত্র’ নারীদের গতানুগতিক ভূমিকাকে বেশি ফোকাস করে, অন্যদিকে ‘নারীমঞ্চের’ মত পাতাগুলো নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তাদের ভয় দূর করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেয়, কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা বলে নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। সুতরাং সংবাদপত্রগুলোর ‘নারীপাতা’ যেমন নারী উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে তেমনি ‘নকশা’র মত পাতা বের করে নারীদের
ঘর গৃহস্থালির উপর জোর দিয়ে তাদের রূপচর্চা, ঘরের কাজের প্রতি বেশি উৎসাহী করে তোলে। এখন আমরা দেখি ‘নারীমঞ্চের’ মত নারীপাতাগুলো কিভাবে নারী উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে-
১. নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে : নারীদের সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করে, নারীদের অধিকার সম্পর্কে লেখালেখি করে নারী পাঠকদের এ ধারণা দেয় যে তারাও মানুষ এবং তাদেরও পুরুষের মত সবকিছুতে সমঅধিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। নারীরা যে পুরুষের চেয়ে অধস্তন নয়, তারাও যে পুরুষের সমমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ এ ধারণা নারীদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে।
২. নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে : বিভিন্ন বিখ্যাত নারী ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন সংগ্রামী নারীদের জীবন ইতিহাস তুলে ধরে নারী পাঠকদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এসব পড়ে নারী পাঠকরা ভাবে যে অন্যরা যদি পারে তাহলে তারা কেন পারবে না। ফলে তারা বিভিন্ন কাজে উৎসাহী হয়ে উঠে।
৩. জনগণকে নারী সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয় : আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মত আমাদের সমাজেও নারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত। নারীদের পুরুষের চেয়ে অধস্তন, নারীদের নিষ্ক্রিয়, দুর্বল মনে করা হয়। তাদের বাইরের কাজের অনুপযুক্ত মনে করা হয়। কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ ধরনের নারীপাতা পড়ে নারী- পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নারীদের সম্পর্কে সচেতন হয় এবং নারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন হয়।
৪. নারীদের বাইরের কাজে উৎসাহী করে তোলে : বিভিন্ন চাকরিজীবী, অফিস আদালতে কাজ করে এ রকম নারীর কথা তুলে ধরা হয় এসব পাতার মাধ্যমে। নারীরা যে ঘরের কাজ ছাড়াও বাইরের কাজ করে সাফল্য অর্জন করতে পারে তা এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ফলে অন্যান্য নারীরা বাইরে কাজ করতে উৎসাহী হয় এবং বাইরের কাজে অংশগ্রহণ করে।
৫. নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সাহায্য করে : সংবাদপত্রের নারীপাতা পড়ে নারীরা বাইরের কাজে অর্থাৎ আয়মূলক কাজে অংশগ্রহণ করে ফলে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বাড়ে এবং সর্বোপরি নারীর সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন হয়। নকশা’র মত নারীপাতাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব : নকশার মত নারীপাতাগুলো নারীদের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
ক. নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন : সংবাদপত্রের পাঠক মাত্রই লক্ষ্য করেছেন যে, ‘নকশা’র মত নারী পাতাগুলোতে নারী মুখই বেশি বেশি প্রাধান্য পায় তাও আবার সুন্দরী নারীদের। এটাও এ বাজারি পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ার চাল যেখানে নারীকে পণ্য বানিয়ে অধিক মাত্রায় বিক্রি করা যায়। বিভিন্ন নারী স্টারদের ছবি দেওয়া হয় মডেল হিসেবে, যাতে পত্রিকা অনেক বেশি বিক্রি হয়। এখানে তাদের মুনাফা অর্জনই প্রধান লক্ষ্য, নারীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এ হিসেবে তাদের ছবি দেওয়া হয় না, বরং বেশি পত্রিকা বিক্রির জন্য পণ্য হিসেবে তাদের উপস্থাপন করা হয়।
খ. রূপচর্চার উপর প্রাধান্য : এসব পাতায় নারীদের রূপচর্চার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। নারীরা আরও কিভাবে সুন্দর কোমল হতে পারবে সে বিষয়ে নিয়মিত টিপস দেওয়া হয়। এসব পড়ে মনে হয়, পৃথিবীতে নিজেকে নামিদামি আইটেম দিয়ে সাজানো আর অন্যের কাছে ‘আকর্ষণীয়’ করে তোলা ছাড়া নারীর আর কোন কাজ নেই। একদিকে পত্রিকাগুলো ‘নারীমঞ্চের’ মত পাতা বের করে নারীমুক্তির কথা প্রচার করে, অন্যদিকে ‘নকশা’র মত পাতায় নারীকে স্রেফ ভোগবাদী দেহ সর্বস্ব হিসেবে তুলে ধরে।
গ. পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে : ‘নকশা’র মত পাতাগুলো একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এতে নারীর চেহারা সুরত কি পরিমাণে প্রদর্শিত হচ্ছে। এটাও পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। নারীকে আইটেম বানিয়ে নানাভাবে উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে পাঠককে আকর্ষণ করানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে নারীকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সমাজে নারী সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই চমৎকারভাবে বজায় রাখে আমাদের পত্রিকাগুলো।
ঘ. লিঙ্গবৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে : ‘নকশা’র মত পাতাগুলোতে ফ্যাশন সংবাদের ছবিগুলোতেও বেশিরভাগ নারীর মুখ ছাপানো হয়ে থাকে। আসলে এ ধরনের পাতায় নারী মডেল স্টারদের ছবিই ভরপুর থাকে। অর্থাৎ মিডিয় ব্যবসায় নারীই হয় প্রধান পণ্য, যা ভাঙিয়ে পত্রিকাগুলো নারীর গতানুগতিক একপেশে পুরুষতান্ত্রিক প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে পত্রিকাওয়ালারা মনের সুখে ব্যবসায় চালায় আর সমাজের নারী-পুরুষের আধিপত্যবাদী লিঙ্গবৈষম্যকে আরও শানিয়ে তোলে।
ঙ. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদের অনুপস্থিতি: রূপনকশা, ফ্যাশন সংবাদ, পোশাকের বিজ্ঞাপন, ঘর নকশার আইটেম ইত্যাদি সংবাদগুলোর মাধ্যমে আমরা যা দেখে থাকি তা হল এদেশের বিত্তবান শ্রেণীর নারীদের জীবনাচরণের খবর। ধনীদের বাইরে যে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা আছে তা থাকে অনুপস্থিত।
চ. নারীদের গতানুগতিক ভূমিকার প্রাধান্য : এসব পাতায় নারীদের গতানুগতিক ভূমিকা যেমন- রূপচর্চা, রান্নাবান্না, ঘর গৃহস্থালি ইত্যাদির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে নারীরা এসব পড়ে ঘরের বাইরে কাজ করার চেয়ে এসব গতানুগতিক কাজের প্রতিই আগ্রহী হয়ে উঠে। আর এসব কাজের যেহেতু কোন অর্থনৈতিক মূল্য নেই তাই নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় না, পুরুষের উপরই নির্ভরশীল থাকে ।
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম, বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত বিশেষ ‘নারীপাতা’ নারী উন্নয়নে যেমন ইতিবাচক ভূমিকা রাখে আবার একইসাথে ‘নকশা’র মত পাতা বের করে নারী উন্নয়নে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*