বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দেশ, জাতি ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নারী-পুরুষ উভয়েই সমান অবদান রেখেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, বিশ্বের কোথাও নারী তার সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নয়, বাদও ১৯৮৬ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু তারা সমগ্র বিশ্বের মোট আয়ের প্রায় এক-দশমাংশ এবং
মোট সম্পদের এক-দশমাংশ বা তার কম সম্পদের মালিক। [Source : Bangladesh Bureau of Statistics, Statistical Pocket Book of Bangladesh. 1988] বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নারীর আর্থসামাজিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নারীদের মর্যাদা, অবস্থান এবং কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে অনেক নিম্নে। এ নিম্নতর অবস্থানের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো ও শতাব্দী লালিত মূল্যবোধ ও বৈষম্য দায়ী। তাই শ্রমশক্তি হিসেবে নারীর মূল্যায়ন কখনও হয় নি। নারীর গৃহাভ্যন্তরীণ পারিশ্রমিকহীন কাজসহ অন্যান্য অদৃশ্য শ্রম জাতীয় উৎপাদনে কখনও প্রতিফলিত হয় নি। তাই জাতীয় অর্থনীতিতে নারীসমাজের ভূমিকা থাকলেও তা অস্বীকৃত।
অর্থনৈতিক কাজে মহিলাদের অবদান : মহিলারা গৃহকর্মের কাজ করার পরেও অর্থ অর্জনকারী দ্রব্য উৎপাদন করে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে থাকে। নিম্নে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অবদান আলোচনা করা হলো :
১. কৃষিতে নারীর অবদান : বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৬৮% কৃষিকাজে নিয়োজিত। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৩০% কৃষি কাজ করে। এদের মধ্যে ১৮ শতাংশ শ্রম দেয় নিজেদের জমিতে আর ১২ শতাংশ শ্রম দেয় মজুর হিসেবে। সাধারণত নারীরা চাষ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে যেসব কাজ করে সেগুলো হলো বীজ সংরক্ষণ, বীজ বপন, চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, ক্ষুদ্রাকৃতির সেচ কাজ, ফসল কাটা, মাড়াই ও ঝাড়া ইত্যাদি। নারীদের একটা বড় অংশ গৃহসংলগ্ন বাগানে শাকসবজি, বিভিন্ন রকম তরকারি, মসলাপাতি, ওষুধের গাছ-গাছড়া ও ফল-ফলাদি উৎপাদন করে থাকে। গৃহসংলগ্ন বাগান বা বন সেগুলো নারীরাই দেখাশুনা করে থাকে। জ্বালানি পশুখাদ্য ইত্যাদি নারীরাই সংগ্রহ করে থাকে। অনেক ভূমিহীন নারী সামাজিক বনায়নে নিয়োজিত। মৎস্য খাতে দেখা যায়, নারীরা শুঁটকি ও নোনামাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরি, মাছের পোনা উৎপাদন ও মাছের পুকুর তৈরির কাজসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে। অনেক ভূমিহীন নারীগ্রুপই মাছ চাষের জন্য সরাসরি জলাশয় লীজ নিয়ে থাকে। এছাড়া হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে মহিলারা। কৃষিখাতে মহিলারা এভাবে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে। অবশ্য কৃষিখাতে মহিলাদের GNP তে অবদানের পরিমাণ লক্ষণীয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ সালে হাঁস-মুরগি উৎপাদন প্রায় ৭৯,৩৬৮ হাজার এবং উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা ৩,৫৬,১২০ হাজার, মোট ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ১,২৬,৮২৮ হাজার। যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে এ হিসাব স্থান পেয়েছে কিন্তু উৎপাদন তা কোথাও স্বীকৃতি
পায় নি ।
২. অকৃষি কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অবদান : অকৃষি কর্মকাণ্ডে মহিলারা কতটুকু জড়িত তার কোনো তথ্য পরিসংখ্যানগুলোতে তেমন পাওয়া যায় না। অথচ সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা নিবন্ধে উৎঘাটিত হয়েছে যে, অসংখ্য মহিলা অকৃষি ও অর্থনৈতিক উৎপাদন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন। ১৯৮১তে BIDS কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, জরিপকৃত থানার মোট জনসংখ্যার ২১,২৭৬ জনের মধ্যে ২,১১৩ জন কুটিরশিল্পে নিয়োজিত। এদের মধ্যে ৩৩% মহিলা বিভিন্ন শিল্পে নিয়োজিত। নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে খনি শিল্পে ৪১.৫% মহিলা, ধান ভানতে ৫৬% মহিলা, মাদুর তৈরিতে ৬২.৮% মহিলা, বাঁশের দ্রব্য তৈরিতে ৪৯% মহিলা, ছোবরা শিল্পে ৬৪.৩%, বেতশিল্পে ৩৭.৬%, মৃৎশিল্পে ৪৭% মহিলা নিয়োজিত ।
৩. পোশাক শিল্প : বর্তমানে আমাদের দেশে অসংখ্য দরিদ্র মহিলা পোশাক শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে। কারণ, আমাদের দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর মধ্যে স্বীকৃত শিল্প হচ্ছে পোশাক শিল্প। দরিদ্র মহিলাদের ব্যাপক নিয়োগ তাদের পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯২-৯৩ সালের মোট ২,০৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের মধ্যে পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ৫৭ শতাংশ। বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ এ তৈরি পোশাক থেকে আসে। এ শিল্পে প্রায় এক মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োজিত। এরমধ্যে সিংহভাগই নারী। এ নারী শ্রমিকের অধিকাংশই অবিবাহিত এবং এদের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে। কিন্তু এ মহিলা শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় নামমাত্র। নিম্নে পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মীদের পারিশ্রমিকের হার উল্লেখ করা হলো নারী কর্মে অধিক মনোযোগী বলে তাদের হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। কেননা, দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সর্বদা তারা সচেষ্ট থাকে। ফলে তারা সুপারভাইজার বলে অধিক অর্থ উপার্জন করে। এ শিল্পের মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার গুরুত্ব আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অপরিসীম।
৪. পেশাগত শিল্পে নারী : বাংলাদেশের শিল্প সেক্টরটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বা ছোট। তাই শিল্প কর্মস্থানের অধিকাংশই গৃহস্থালিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পভিত্তিক। শহরে শ্রমবাজারের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দিকটি হলো গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, টেলিফোন ও টেলিযোগাযোগ শিল্প এবং মৎস্য শিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি রপ্তানিমুখী শিল্পে নারীর একটি বৃহৎ অংশ নিয়োজিত। নারীরা পাট ও বস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসা, স্থাপত্য শিল্প, আইন পেশা, কাগজ শিল্প, বেকারি ও কনফেকশনারি এমনকি কারখানার ব্যবস্থাপনার পদে নিয়োজিত।
মূলত নানারকম প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও নারীর গতানুগতিক অর্থনৈতিক অবস্থান ধীরে হলেও ক্রমশ উত্তরণ ঘটছে। শ্রমশক্তির বিকাশে বিশেষ করে সাম্প্রতিক প্রবণতার বাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশের নারীরা ক্রমবর্ধমান হারে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। কেননা, সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে মোট শ্রমশক্তির অর্ধেক ছিল নারী (২ কোটি)। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নারী শ্রমশক্তির ৮৩% অবৈতনিক গৃহস্থালি, ১০% আত্মকর্মসংস্থান, ৪.৫% বেতনভুক্ত ও ৩% দিনমজুর। শহরাঞ্চলে ২৬% কর্মজীবী নারী ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মরত, ৫% উৎপাদন খাতে, ৪% সেবা এবং ১৭% পেশাজীবী বা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
৫. অসংগঠিত সেক্টরে মহিলাদের কর্মসংস্থান : অসংগঠিত সেক্টরে নিয়োজিত মহিলাদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে আগত, যাদের পুঁজি বা সম্পদ কিছুই নেই। এদের অধিকাংশই গৃহপরিচারিকার কাজসহ ইটভাঙ্গা, ছাদ পেটানো, রাস্তা,ব্রিজ, কালভার্ট তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রতিককালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল এর এক জরিপে দেখা গেছে, অসংগঠিত সেক্টরের ২০% নারী শ্রমিক ইট ভাঙ্গে, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৬. শহর এলাকায় গৃহভিত্তিক অর্থকরী কাজ : বর্তমানে ঘরে বসে শহর এলাকায় অনেকেই অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেয়েছেন। পুতুল তৈরি, সেলাই এবং হস্তশিল্প অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের কাজ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে শহরের বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের শেখানো হচ্ছে। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলারা এ ধরনের কাজ
শেখানোর জন্য ছোট ছোট কেন্দ্র পরিচালনা করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন পণ্যের অর্ডার এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়। অন্যদিকে, আজকাল বহু মেয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি শিখেছে। কন্ট্রাকের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয় নানা ধরনের খাবার তৈরি করে দেয়।
৭. জাতীয় সঞ্চয়ে মহিলাদের ভূমিকা : দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সঞ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ গড়ে উঠে। সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অবদান বেশি। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে একজন মহিলা তার সংসারের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও ব্যবসায় খাটান, বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে লাগান। এছাড়া তাদের সঞ্চয়কৃত টাকা ব্যাংকে জমা রেখে দেশের বিনিয়োগের স্তর বহুগুণ বৃদ্ধি করে। মহিলারা বাড়তি খরচ না করে মাটির ব্যাংকে টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখে যা সঞ্চয় সৃষ্টিতে সহায়ক। ফলে দেখা যায়, একজন মহিলা তার সঞ্চয়কৃত অর্থ দ্বারা দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সুষ্ঠু উন্নয়নের জন্য এবং উন্নয়নের ফল ভোগে সমতা আনয়নের জন্য মহিলারা যে কাজ করছে তার স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। তাদের কাজের গুণগত দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করে এবং নতুন মহিলা কর্মীদের উৎপাদনশীল কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে অর্থনৈতিক কাজে তথা উন্নয়ন কাজে জড়িত করা প্রয়োজন। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, উন্নত বিশ্বে উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণে সকল বাধা দূরীকরণ করেছে যা আমাদেরও করতে হবে। এজন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামো ভেঙে নারীদের উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। তবেই জাতীয় অর্থনীতিতে মহিলারা আরও গতিশীল ভূমিকা রাখবে।