বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনের ধারা উল্লেখ কর।
অথবা, গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য লিখ।
অথবা, গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনের ধারা বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনে ধারা সম্পর্কে লিখ।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনের ধারা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক পরিবর্তন বলতে সামাজিক কাঠামোর পুনর্গঠন বা রদবদলকে বুঝানো হয়।সামাজিক পরিবর্তনের অর্থ সমাজের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, সমাজে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন তথা সমাজ জীবনের রীতি ও নীতির পরিবর্তন। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সমাজের কাঠামো পুনর্বিন্যস্ত হয়। প্রচলিত রীতিনীতি, পুনর্গঠিত হয়, ব্যক্তি ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি শাসনব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তন: গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তন বলতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা ও দৈনন্দিন জীবন প্রণালির পরিবর্তনকে নির্দেশ করা হয়। নিম্নে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তনের ধারা উল্লেখ করা হলো :
১. যান্ত্রিক কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তন : প্রাচীনকালে সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ পরিচালনা করা হতো। লাঙ্গল আর জোয়াল ছিল সনাতন পদ্ধতির মৌলিক কৃষি উপকরণ। বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যার সম্প্রসারণের ফলে কৃষিতে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন।কৃষি কর্মকাণ্ডে কলের লাঙ্গল, বীজ, সার, কীটনাশক, ধান কাটার যন্ত্র, পেডেল থ্রেসার, কৃষাণ মাড়াই কল, হাইব্রিড বীজ ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে এ পরিবর্তন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
২. উৎপাদন উপকরণের পরিবর্তন: উৎপাদনের উপকরণ শুধু কৃষিক্ষেত্রেই পরিবর্তন সাধন করেনি বরং সমগ্র জীবনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। প্রাচীন কৃষি যন্ত্রপাতির পরিবর্তে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।গৃহস্থালির নানা কর্মকাণ্ডে আচারঅনুষ্ঠানে, কৃষিজ কর্মকাণ্ডের বাইরে যান্ত্রিক পণ্যসমাগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন: সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার।বর্তমানে দেশে শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সত্তরের দশক পর্যন্ত দেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। বর্তমানে দেশে প্রায় সব গ্রামেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বয়স্ক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প, সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন প্রভৃতি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : অযান্ত্রিক যানবাহন গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার এক অন্যন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। বর্তমানে গ্রামীণ রাস্তাগুলোর সংস্কার করার ফল যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে শুধু উন্নত যানবাহন সৃষ্টির কারণে
৫. গ্রামীণ ও শহুরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন: গ্রামীণ জীবন একদা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজের চাহিদা পূরণের মতো সম্পদ প্রত্যেকেরই ছিল। তবে ধীরে ধীরে এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। শহরের সাথে যোগাযোগের পর থেকেই এভাবে প্রভাবসমূহ গ্রামীণ জীবনের উপর পড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে শহরের নানা প্রয়োজন মিটানোর জন্য শহরসমূহ গ্রামের উপর নির্ভরশীল। আবার শহরের নানা পণ্যসামগ্রীর উপর গ্রামের মানুষ নির্ভর করে। এ কারণে শহর ও গ্রামসমূহ নিজেদের সুবিধার স্বার্থে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে।
৬. উন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিবর্তন : গ্রামীণ সমাজে নিরক্ষরতা দূরীকরণ নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ কুসংস্কার দূরীকরণের সরকারি সংস্থাগুলো পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো ও ভূমিকা পালন করেছে। এসব সংস্থাগুলো সমাজে নানামুখী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া গ্রামীণ জীবনের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে ধীরে ধীরে গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন ঘটেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজের সামাজিক পরিবর্তন বহুবিধ উপাদানের সমন্বয়ে হয়ে থাকে। এসব কারণসমূহ গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি পরিবর্তন আনয়ন করে। শিক্ষা, পেশাগত বৈচিত্র্যতা, উৎপাদনের আধুনিক উপকরণ, শহুরে জীবনের সাথে গ্রামীণ জীবনের সম্পৃক্ততা, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সচেতনতা অর্জন বাজার অর্থনীতির বিকাশ সবই গ্রামীণ সমাজ পরিবর্তনের অনন্য উদাহরণ ।