বাংলাদেশের গারো অথবা রাখাইন এথনিক গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাখাইন এথনিক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন আলোচনা কর।
অথবা, গারো অথবা রাখাইনদের জীবন প্রণালি আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : যুগ যুগ ধরে এদেশে বহু উপজাতির বাস। গারো বাংলাদেশের একটি উপজাতি। গারোদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যা তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে ।
বাংলাদেশের গারো সমাজ : নিম্নে বাংলাদেশের গারো সমাজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. গারো নামকরণ : গারো পাহাড়ের নামানুসারে গারো নাম-নাকি গারোদের নামানুসারে গারো পাহাড়ের নাম সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গারোরা বনজঙ্গলে আর পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে বিধায় সমতলবাসী বাঙালিরা তাদের প্রথম থেকেই গারো নামে ডাকতে শুরু করে। গারোরা অবশ্য নিজেদের প্রায়ই মান্দি বলে পরিচয় দেয়। মান্দি অর্থ মানুষ।
২. গারোদের বাসস্থান : গারো সমাজের অধিকাংশই ভারতের আসাম (মেঘালয়) জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বসবাস করে। এছাড়া ঢাকা জেলার উত্তর, রংপুর জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং সিলেট চা বাগানে সামান্য কিছু গারো দেখতে পাওয়া যায়।
৩. গারো জনসংখ্যা : ভারতের আসাম জেলার গারো পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ২,৩৭,৮৪২ জন গারো বসবাস করে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে মোট গারোর সংখ্যা ৮০,০০০ এর মতো। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ৫০,০০০ এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে ২০,০০০ গারো বসবাস করে। ঢাকা, রংপুর এবং সিলেট অঞ্চল মিলে প্রায় ১০ হাজার গারো বাস করে। অতএব ভারত ও বাংলাদেশে মোট গারোর সংখ্যা ৩,১৭,৮৪২ জন। এ সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. গারোদের ভাষা : এদের ভাষার স্থানীয় নাম মান্দি ভাষা বা গারো ভাষা। গারোদের কোনো লিপি বা অক্ষর নেই। তবে বর্তমানে ভারতের গারোরা আসামাঞ্চলে গারো ভাষা লিখছে।
৫. গারোদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় : নৃগোষ্ঠীগতভাবে গারোদের মঙ্গোলয়েড-ই বলা চলে। কেননা তাদের মধ্যে মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অনেক বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করা যায়।
৬. গারোদের ধর্ম : বাংলাদেশের বর্তমান গারোদের ৯০% ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। প্রায় ২% মুসলিম ও হিন্দু। বাকি প্রায় ৮% এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ধর্মই প্রাধান্য পাচ্ছে। গারোদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম সংসারেক ঐতিহ্যগতভাবে গারোরা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী। তারা যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে তার নাম মিতে বা মাইতে। মাইতে দেবদেবী এবং
প্রেতাত্মা উভয়কে বুঝাতেই ব্যবহৃত হয়। গারোদের মতে কিছু মাইতে দয়ালু, পরোপকারী তথা বন্ধুবৎসল। অপরপক্ষে,
কিছু মাইতে নির্দয় এবং শত্রুভাবাপন্ন। গারোরা উভয় ধরনের মাইতেকেই পূজা অর্চনার দ্বারা খুশি করতে চায়।
৭. গারো সামাজিক সংগঠন : গারো সমাজ মূলত মাতৃসূত্রীয়। তাদের সবচেয়ে বৃহৎ মাতৃসূত্রীয় দল বা গোত্রের নাম চাটচী যার অর্থ আত্মীয় বা জ্ঞাতি। পাঁচ ধরনের চাটচী গোত্র রয়েছে। যথা : সাংমা, মারাক, মমিন, সিরা এবং আবেং।
৮. গারো সমাজের পরিবার এবং বিবাহ ব্যবস্থা : গারো পরিবার মাতৃসূত্রীয়। অর্থাৎ সম্পত্তি ও বংশ নাম ‘মাতৃধারায় মাতা থেকে মেয়েতে বর্তায়। গারো দম্পত্তি স্ত্রীর বাবার গৃহে বসবাস করে। অর্থাৎ সেখানে মাতৃবাস রীতি অনুসরণ করা হয়। গারো পরিবার মাতৃপ্রধান। পরিবারের ক্ষমতা তাত্ত্বিকভাবে স্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত। পরিবারের সম্পত্তির মালিক স্ত্রী। তবে ব্যবস্থাপনার মালিক স্বামী। তাই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে উভয়কেই যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গারো সমাজে Parallel cousin বিবাহ নিষিদ্ধ এবং Cross cousin বিবাহ অনুমোদিত। গারোদের বিবাহ সম্পত্তি ও তার উত্তরাধিকার রীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
৯. বিবাহবিচ্ছেদ : গারোদের বিবাহবিচ্ছেদ খুবই কম। বিবাহবিচ্ছেদ শালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। বিচ্ছেদে স্বামী বা স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দোষী ব্যক্তির গোষ্ঠীর লোক অন্যপক্ষকে জরিমানা দেবার শর্তে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
১০. গারো অর্থনীতি : বাংলাদেশের গারোরা আগে জুম বা পালাক্রম চাষ করতো। জুম বা পালাক্রম চাষে তারা প্রধানত ধান এবং নানা জাতের সবজি উৎপাদন করতো। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে গারোরা ১৯৫০ সালের পর থেকে আর জুম চাষ করছে না। এখন তারা হাল কৃষিতে অভ্যস্ত হয়েছে। হাল কৃষির সাহায্যে তারা প্রধানত ধান, নানা জাতের
সবজি ও আনারস উৎপাদন করছে।
১১. গারো নেতৃত্ব ও রাজনীতি : গারো গ্রাম সমাজের প্রধান গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রামীণ বিচার আচার পরিচালনা করেন। তবে গারো সমাজে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। গারো অঞ্চলেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা (যেমন- ইউনিয়ন, থানা) গড়ে উঠেছে, ফলে গারো নেতৃত্বে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি বা নির্বাচিত কোনো চেয়ারম্যান মেম্বারদের ক্ষমতা ঐতিহ্যবাহী গারো গ্রাম প্রধানের চেয়ে অনেক বেশি এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নেতৃত্বই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
১২. গারোদের শিক্ষা : গারোদের নিজস্ব লিপি বা বর্ণমালা নেই। তবে বাংলাদেশি গারোরা বাংলা হরফে গারো ভাষা লিখতেন। বর্তমানে ২০% এরও অধিক গারো লোকই শিক্ষিত বলা চলে।
১৩. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : গারোদের বিশ্বাস দেহ থেকে আত্মা বিদায় নিলেই মৃত্যু ঘটে। আত্মা অমর। তাদের বিশ্বাস মৃত্যুতে আত্মা চিকমাং নামক স্থানে চলে যায়। চিকমাং হলো মৃতের দেশ। তাদের বিশ্বাস গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বে (ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে) পাহাড়ের চূড়ায় চিকমাং অবস্থিত। তাদের বিশ্বাস চিকমাং -এ কেবল মৃতেরাই যেতে পারে। জীবিতরাও নয়। গারোরা মৃতদেহের গোসল দেয়, গোসলের পর মৃতদেহ মেঝেতে রেখে দেয়। মরদেহের মাথার কাছে খাবার (চাল, ভাত, ডিম) রেখে দেয়। এদেরকে ঘিরে অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। যাহোক, মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন একরাত ওখানেই রেখে দেয়ার পর তা কোনো এক রাতে সাধারণত দ্বিতীয় রাতে পোড়ানো হয়। গারো মৃতদেহ দিনের আলোয় পোড়ানোর রীতি নেই। মৃতদেহ পোড়ানোর ছাই জঙ্গলে নিয়ে ফেলে দেয়। হাড়গুলো মাটির পাত্রে তুলে মৃতের বাড়ির কাছে মাটির গর্তে পুতে রাখে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাখাইন উপজাতিদের স্বকীয়তা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতো লক্ষণীয়। তারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে স্বতন্ত্র উপজাতি হিসেবে এদেশে বসবাস করছে। জাতিগত স্বকীয়তা এবং মূল্যবোধ তাদেরকে অন্য উপজাতি থেকে পৃথক করেছে। তারা বৌদ্ধদের অনুকরণ করে
এদেশে নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।