বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘একরাত্রি’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

অথবা, “আমার আম্মুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”- উক্তিটির আলোকে ‘একরাত্রি’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলা ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথের হাতেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে। বাংলা ছোটগল্পে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। মানবজীবনের সুখদুঃখ, হাসি-কান্না নিয়ে রচিত তাঁর ছোটগল্পে জীবনের নানা অন্তগূঢ় রহস্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ‘একরাত্রি’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প হিসেবে স্বীকৃত।
নামকরণের গুরুত্ব : সাহিত্য রচনায় নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামকরণের মাধ্যমেই লেখকের সাহিত্য সৃষ্টির সার্থকতা ফুটে উঠে। নামকরণের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে লেখকের মূল উদ্দেশ্য। একটি সার্থক নাম সার্থক সৃষ্টিরই পরিচয় বহন করে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন কেউ রাখলেও রাখতে পারে; তবে সাহিত্য রচনায় নামকরণের ক্ষেত্রে তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।
সাহিত্য রচনায় শিল্পসম্মত একটি নাম রচনাটির উৎকর্ষতা নির্দেশ করে।

নামকরণের ভিত্তি : সাহিত্য রচনায় নামকরণের ক্ষেত্রে রচয়িতারা কতকগুলো বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চরিত্র, বিশেষ কোন ঘটনা, কাহিনির অন্তনির্হিত ভাববস্তু ইত্যাদি। বক্তব্যকে স্পষ্ট করার জন্য লেখক এ সমস্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তাঁর রচনার জন্য একটি নাম বেছে নেন।
একরাত্রি গল্পের নামকরণ : ‘একরাত্রি’ গল্পের নামকরণ করা হয়েছে একটি বিশেষ রাতের মাহাত্ম্যের উপর ভিত্তি করে। নায়কের জীবনে একটি রাতের উপলব্ধি থেকে রবীন্দ্রনাথ এ গল্পের নামকরণ করেছেন ‘একরাত্রি’। একরাত্রির বিষাদঘন পরিবেশ এ গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
একরাত্রি গল্পের কাহিনি : সুরবালা এবং নায়ক একে অপরের খেলার সাথী। ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনুরাগের সম্পর্ক ছিল। দুই পরিবার তা নিয়ে বেশ মজাও করতো। মায়েরা মন্তব্য করতো ‘দুটিতে বেশ মানায়। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে নায়ক কলকাতায় গমন করে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে জড়িয়ে পড়ে স্বদেশী আন্দোলনে। দেশের সেবা
করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা তার প্রধান আদর্শ হয়ে উঠে। ভুলে যায় সে বাল্যসখী সুরবালার কথা। উভয় পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হলেও নায়ক তা প্রত্যাখ্যান করে। আজীবন বিবাহ না করে স্বদেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। অবশেষে একদিন নায়কের মনে হয় ভাবকল্পনার আতিশয্যে নেয়া তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তার যা হওয়ার কথা ছিল ; সে তার কিছুই হতে পারেনি।
গল্পের নাম একরাত্রি কেন : মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যা তাঁর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। তেমনি ‘একরাত্রি’ গল্পে নায়কের জীবনে এমন একটি রাতের উদয় হয়েছিল যা তার তুচ্ছ জীবনে একমাত্র চরম সার্থকতা বয়ে নিয়ে আসে। এজন্য গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গল্পের নামকরণ করেছেন ‘একরাত্রি’।
গল্পের বিষয়বস্তু : ‘একরাত্রি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবজীবনের একটি সূক্ষ্মতম রহস্য পাঠক সমাজের সামনে তুলে ধরেছেন। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে অতি সহজে যে যা কিছু পায়; তার সে মূল্য দেয় না। অলীক কল্পনায় বিভোর থাকতে সে ভালবাসে। যা কিছু সহজ অনায়াসপ্রাপ্য তাকেই সে করে তুলে দুষ্প্রাপ্য স্মৃতিময়। অবশেষে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে। কবির ভাষায় “মনুষ্যসমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারও মনে পড়ে না। তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।”
গুরুত্বপূর্ণ সেই একটি রাত : উচ্চ জীবনাকাঙ্ক্ষা দূরীভূত হয়ে নায়ক এখন নোয়াখালী অঞ্চলের একটি স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। স্কুলের অনতিদূরে সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাড়িতে সে দেখা পায় তার বাল্যসহচরী সুরবালার। সে এখন রামলোচন বাবুর বিবাহিতা স্ত্রী। তবুও সুরবালাকে দেখার পর থেকে তার সুপ্ত প্রেম উজ্জীবিত হয়ে উঠে। অবশেষে আসে সেই একরাত্রি। সেদিন ছিল সোমবার। সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। তারপর রাত একটা দেড়টার দিকে ধেয়ে এল বানের জল। প্রলয়ংকর সেই রাতে নায়ক এবং সুরবালা আবার কাছাকাছি হলো। তাদের মাঝে এখন মাত্র প্রশ্বাসের দূরত্ব। কেবল একটি ঢেউ এলেই বিচ্ছেদের সব বাধা দূর হয়ে যেতে পারত। তবুও কেউ কাউকেও একটা কুশল প্রশ্ন করল না। দুর্যোগ শেষ হলে যে যার ঘরে ফিরে গেল। নায়কের জীবনে সে রাত বয়ে নিয়ে আসে অপার গুরুত্ব- ‘আমি এ একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।’
একরাত্রি গল্পের নামকরণের সার্থকতা : ‘একরাত্রি’ গল্পে গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত আয়োজন আমরা লক্ষ্য করি ঐ একটি রাত্রিকে কেন্দ্র করে। ভয়ঙ্কর সেই প্রলয়ংকর রাতে নায়ক এবং সুরবালার একত্রিত হওয়া; নীরবে ঘরে ফিরে যাওয়া- জীবনের একটি বিষাদঘন দিকেরই ইঙ্গিত করে। ঐ একটি রাতেই নায়ক উপলব্ধি করে সুরবালা তার কতটুকু জুড়ে আছে। সুরবালা স্বামীর ঘর করেও বাল্যসাথীকে এতটুকু ভোলেনি তাও বুঝা যায় ঐ একরাতে। নায়ক তার সমস্ত জীবনের ভুল বুঝতে পারে এবং আত্মপ্রসাদ লাভ করে বলে- এ রাত্রির সেই মহেন্দ্রক্ষণ থেকে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি রাত্রির উদয় হইয়াছিল। আমার আয়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।
উপসংহার : আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রেমকাতর নায়ক অবশেষে আত্মতুষ্টির স্বাদ লাভ করেছে প্রলয়ঙ্কর একরাতে। ক্ষণকালের মিলনের সে রাতটি তার চেতনায় নতুন বোধের জন্ম দিয়েছে। একটি রাতের মধ্য দিয়েই দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের সমস্ত সারবস্তুকে পাঠক সমাজের সামনে তুলে ধরেছেন। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি এ গল্পের নামকরণ ‘একরাত্রি’ সার্থক এবং শিল্পসফল হয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*