“বনলতা সেন” কাব্যের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির শিল্পমূল্য আলোচনা কর।

উত্তর ভূমিকা : তিরিশের দশকের বাঙালি কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) একজন প্রধান কবি। মনন- মেধায়, চিন্তা-চেতনায়, চিত্রকল্প রচনায়, বিষয় নির্বাচনে, আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর কাব্য প্রতিভা স্বকীয় স্বতন্ত্রধারা অনুসারী ও বিস্তারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর হতাশা, নব্ ঔপনিবেশবাদ, রাজনৈতিক সংকট, বাণিজ্যিক মন্দা, মানুষের মানবিক অবক্ষয় জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তাঁর সমকালীন সমাজের বন্ধ্যাত্ব, অন্তঃসারশূন্যতা জীবনানন্দের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। অস্তি ত্ববাদী চেতনার সামীপ্য জীবনানন্দকে পৌঁছে দিয়েছিল আধুনিক মানব অস্তিত্বের সম্মুখবর্তী ভয়াবহ শূন্যতায় এবং তা থেকে উদ্ভূত বিপন্নতায়। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃত অর্থেই একজন অতি আধুনিক কবি এবং আধুনিক রীতির প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিবর্ণ- বিষণ্নতা তাঁর কাব্যের মূল সুর ও মর্মকাহিনি। তিনি উল্লেখ করেছেন- “সকলেই কবি নয়- কেউ কেউ কবি; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা আছে।” (কবিতার কথা) “বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা ‘বনলতা সেন’। কবি এ কবিতাটির ভাব সংগ্রহ করেছেন Adger Alan Poe এর To Helen কবিতা থেকে। ‘বনলতা সেন’ কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা না হলেও তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা। কবির জীবনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইংরেজি, ফারসি, গুজরাটি, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনূদিত হয়েছে। শাস্ত-শান্তি-শ্রী ও আশ্রয়ের প্রতীক বনলতা সেন। এ কবিতায় বহুদিন যাবৎ এক পরিব্রাজক পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কবির ভাষায় :


“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।”


“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, এখানে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-পরিব্যাপী পরিভ্রমণের কথা আছে। সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠীর ভাষায়, “Timeless এবং Temporal এর সময় সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে হয়নি। বর্তমান যুগে প্রেমের অপরিহার্য রূপ দেখে কবি ব্যথিত, সৌন্দর্য হীনতায় পীড়িত। তাই তিনি প্রেমের ও সৌন্দর্যের প্রকৃত স্বরূপকে খুঁজেছেন ভূগোল ও ইতিহাসের বৃহত্তর পটে।”


জীবনানন্দ দাশ: আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়


প্রাচীন ভারতের বণিকেরা যে পথ ধরে বেয়ে দ্বীপময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে যেতো- সে পথ বেয়েই পৃথিবী পরিভ্রমণে বের হয়েছেন এ কবিতার কবি। যেমন-


“অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;”


সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে যেখানে ছিলাম আমি: আরো দূরে অন্ধকার বিদর্ভ নগরে; কবি ইতিহাসের পটে নারীকে উপস্থাপিত করে তার সৌন্দর্য অপরূপত্ব দিয়েছেন,


‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য;


এখানে ‘শ্রাবস্তী’, ‘বিদিশা’ কথাগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে কোনো এক মন্ত্রবলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে এক ‘dream-heavy land’ i ‘বনলতা সেন’ কবিতার বনলতা সেন প্রকৃতপক্ষে কোন বিশেষ নারী বা ব্যক্তি নয়- সে হৃদয়বান এবং প্রেম ও শান্তির প্রতীক এক চিরন্তন মানবী। যে আবহমানকাল ধরে প্রেম ও শাস্তির ধারাকে অব্যাহত রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও প্রতিকূলতার মধ্যেও তা বজায় রাখবে। কবিতার প্রারম্ভিক পংক্তি- “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”- এতো কোন ব্যক্তির প্রেম ও শাস্তি র অম্বেযার পথযাত্রা নয়; বরং চিরকালের মানবযাত্রারই অন্য নাম। এই মানবযাত্রার মধ্যেই নিহিত আছে শান্তি এবং সমৃদ্ধির বাণী। কবির ভাষায়-


“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”


‘বনলতা’ এখানে এক অর্থে নারী- আরেক অর্থে প্রকৃতি। জীবনানন্দ দাশের কবি সত্তা প্রকৃতিতেই শাস্তির সন্ধান করেছে। জীবনের আঘাত, বিক্ষোভ, অশান্তিতে তিনি আশ্রয় পেতে চেয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে। প্রকৃতির মধ্যে শান্ত হতে চেয়েছে তাঁর অশান্ত হৃদয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে ইতিহাস আমাদের গৌরবের আমাদের অহঙ্কারের এবং সমৃদ্ধির। কবি তাই বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমাদের সেই ইতিহাসকে। যেমন-


“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারু-কার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।”


এ কবিতায় একই সাথে অন্তর্লীন হয়ে প্রেম-স্বপ্ন- আনন্দ-বেদনা-মৃত্যু- সমকাল এবং মহাকাল। প্রেম এবং মৃত্যুর অনিবার্য সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে এ কবিতাতে। বনলতার সাথে কবির মিলন তখনই হয় যখন এ জীবনের আর চাওয়া-পাওয়া থাকে না। কবিতার ভাষায়-


“সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী ফুরায়- এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”


‘বনলতা সেন’ কবিতায় ভাষার ব্যবহারের দিক থেকে দেখা যায়- এ কবিতায় তিনটি সম্পূর্ণ অর্থযুক্ত বাক্য বা চরণ। এ তিনটি বক্যে তিনটি প্রত্যয়াস্ত ক্রিয়া রয়েছে- হাঁটিতেছি, ঘুরেছি, ছিলাম। কবি তাঁর অনুবাদে ‘ধূসর’ এর প্রতিশব্দ হিসেবে বেছে নিয়েছেন Dim বাংলায় যার অর্থ দ্যোতনা, নিষ্প্রভ, কম আলোকিত, ঝাপসা, অস্পষ্ট, অনুজ্জ্বল। সম্ভবত তিনি পরিবেশ এবং ছন্দ সৃষ্টির প্রয়োজনে ‘ধূসর’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। সফেন’ শব্দটি কবির তৈরি বিশেষণ। মূল কবিতায় ‘পথ’ শব্দটি একবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘হাঁটা’ কর্মের ক্রিয়া হিসেবে এবং আর একবার ‘পৃথিবীর পথ’ কথাটি ব্যহৃত হয়েছে হাঁটা ক্রিয়ার প্রসারক হিসেবে। তবে জীবনানন্দের কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় উপমা রচনায়। তাঁর উপমাগুলো বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান ঐশ্বর্য। কোন কবি প্রসিদ্ধির অনুসরণ না করে সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশ থেকে রসঘন উপমা সৃষ্টিতে তাঁর তুলনা বিরল। যেমন-


“পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”


এছাড়া এ কবিতাতে কবি অনুপ্রাসের ব্যবহারেও নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। যেমন-

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।”
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত।
‘হাজার বছর ধরে/ আমি পথ হাঁটিতেছি/ পৃথিবীর পথে। ৮+৮+৬= ২২


জীবনানন্দের এই অসাধারণ ছন্দ বৈচিত্র সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন “ তাঁর কবিতায় কলা-কৌশলের অভাব নেই, ছন্দ তাঁর কোথাও টলেনি। মিল, অনুপ্রাস, পুনরুক্তিতে যথেষ্ট বৈচিত্র্য আছে।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবি শব্দ, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ব্যবহারের দিক থেকে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কবির কবিতায় বর্ণের খেলা, রঙের আভা, অসংখ্য উপমা, বাস্তব-পরাবাস্তববাদী রঙের পরশসহ বিচিত্র প্রকাশধর্মিতা। সুতরাং ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দ দাশের একটি শিল্পসফল কবিতা।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!