ফররুখ আহমদ রচিত ‘ডাহুক’ কবিতার সারমর্ম ভাবার্য/মূলভাব/ ভাববস্তু নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ইসলামি রেনেসাঁ আন্দোলনের পটভূমিতে নিজস্ব আদর্শ ও ঐতিহ্যের ধারায় যাঁরা কাব্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) অন্যতম। ইসলামের মহান আদর্শে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। তাঁর রচনায় মুসলিম ঐতিহ্যমূলক বিষয়ের ব্যবহার অবধারিত। বাহ্য জগতের অন্তরালে আধ্যাত্মিক চেতনার সম্মিলন তাঁর অনেক কবিতায় লক্ষ করা যায়। ‘ডাহুক’ তাঁর এমনি একটি গভীর অধ্যাত্মচেতনা সমৃদ্ধ কবিতা । ডাহুক গ্রামবাংলার অতি পরিচিত একটি পাখি। বিশেষ প্রজাতির এ জলজ পাখিটি বাড়ির আশপাশে ডোবার ধারে, ঝোপে জঙ্গলে বাস করে। সদা চঞ্চল এ পাখিটি আর পাঁচটি পাখির মতো সচরাচর দৃশ্যমান হয় না। লোকচক্ষুর আড়াল থেকে সে শুধু অশ্রান্ত ডেকে যায়। ডাহুক পাখিকে নিয়ে গ্রাম বাংলায় অনেক গল্পকাহিনী ছড়িয়ে আছে। ডাহুক প্রেমিক পাখি। কোন কারণে তার সঙ্গীবিচ্ছেদ ঘটলে সে অবিরাম ডেকে যায়। বিরহ যাতনায় ডাহুক ডেকে ডেকে আত্মাহুতি পর্যন্ত দেয়। ডাহুক একটি বিশেষ প্রজাতির পাখি হয়েও বিশিষ্ট কবি ফররুখ আহমদের অসাধারণ কবি প্রতিভার কালজয়ী একটি কবিতার আধার হয়ে উঠেছে। ইংরেজি সাহিত্যে স্কাইলার্ক পাখিকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অনেক বিখ্যাত কবিতা। ওয়ার্ডস ওয়ার্থ ও শেলীর বিখ্যাত কবিতা ‘টু এ স্কাইলার্ক’। ইংরেজ কবিরা স্কাইলার্ক পাখির মুক্ত পাখায় ভর করে আত্মমুক্তির পথ খুঁজেছিলেন। বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ ডাহুক পাখিকে আশ্রয় করে আত্মোপলব্ধি ও মুক্তির পথ খুঁজেছেন। ডাহুকের সুর কবি হৃদয়ে এনে দিয়েছে এক অনাবিল প্রশান্তি। ডাহুকের ডাকে কবি উপলব্ধি করেছেন অতীন্দ্রিয় এক অনুভূতি। গভীর নিস্তব্ধ রাত্রি। সমস্ত প্রকৃতি অতল নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কবি জেগে আছেন একাকী। রাত্রির গভীরতা ভেদ করে ভেসে আসে অশ্রান্ত ডাহুকের ডাক। কবির অন্তর্জগতে শুরু হয় আলোড়ন। এক ভিন্নতর আবেদন কবি হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। ডাহুকের সুরে কবি খুঁজে পান ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। ডাহুকের সুর-রাগিনী সুরা স্রোত হয়ে কবিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। মানবাত্মার চিরচেনা অথচ অচেনা সুরটিই কবি রাত জেগে শুনতে থাকেন ডাহুকের কণ্ঠে। অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যায় কবি হৃদয়। সুরের সুরার মত্ততায় কবি যেন মানবাত্মার মুক্তির পথ খুঁজে পান।
“ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।”
ডাহুকের কণ্ঠে কবি শোনেন মুক্তির আহ্বান। ডাহুক মুক্তির প্রতীক। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ মুক্তি খোঁজে। অতৃপ্তি অপ্রাপ্তির বেদনা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে প্রতিনিয়ত। আত্মনিপীড়নে নিজেদের দগ্ধ করে চলেছে মানুষ। সকলে মুক্তি চায়; কিন্তু পথ জানা নেই। আর ঠিক তখনই কবি মুক্তির পথ খুঁজে পান ডাহুকের ডাকে।
“ডাহুকের ডাক
সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন
হয়ে আসে নীরব নির্বাক।
মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক তার পূর্ণ বুক রিড করে ডাকতে পারলেও মানুষ পারে না। মুক্তির স্বাদ নিতে ম্লান কদর্যের দলে ডাহুক নেই। স্বার্থচিন্তায় মানুষ নিজেদের দেহমন সব সময় শৃঙ্খলিত করে রাখে। ডাহুক শৃঙ্খলমুক্ত, পরিপূর্ণ তার জীবন।
“তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক
পূর্ণ করি বুঝ রিক্ত করি বুক
অমন ডাকিতে পার। আমরা পারি না।”
ডাহুকের ডাক শুনে প্রথমে কবির মনে হয়েছে ডাহুক এক অবিনাশী সুরের প্রতিমূর্তি। কিন্তু আবার পরক্ষণেই কবির মনে হয়েছে। সে তো সুরযন্ত্র। সুরের উৎস অসীম। সে নিজে ডাকে না, অসীম সত্তার সুর তার সুরযন্ত্রে বেজে উঠে।
“অপরূপ সুর অফুরণ সুর৷
ম্লান হয়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা ডাহুকের ডাকে।”
রাত্রি গভীর হয়। একসময় চাঁদ নেমে আসে প্রাচীন অরণ্যতীরে। জীবন মৃত্যুর সম্মিলনে কবি বেদনায় নীল হয়ে পড়েন। জীবনের হিসাব নিকেশ আজ এলোমেলো। ডাহুকের ডাক কবির চেতনালোকে আলোড়ন তোলে। মানুষের অসহায়ত্ব কবিকে ব্যাকুল করে তোলে। নিভৃতচারী ডাহুক কবিকে আজ স্মরণ করিয়ে দেয় জৈবিকতার প্রাকারে বন্দী মানুষের মুক্তি প্রায় অসম্ভব-
“মুখোমুখি বসে আছি সব বেদনার ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে,
রাত্রি ঝরে পড়ে পাতায় শিশিরে বেদনা নির্বাক।”
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, মানবতাবাদী কবি ফররুখ আহমদ ডাহুককে অবলম্বন করে মানবজীবনের এক গূঢ় রহস্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন। মানবাত্মার চিরন্তন কামনা পরমাত্মার সান্নিধ্যলাভ। কিন্তু মানুষের মুক্তি মেলে না। স্বার্থপরতা এবং পাপলিপ্ত কদর্য জৈবিকতার বুননে ভুলে যায় সে স্রষ্টার কথা। অবশেষে কবি আত্মশুদ্ধি ও আত্মানুশীলনের পথটি খুঁজে পান ডাহুকের একনিষ্ঠ সুরস্রোতে।