বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে বাধাসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিস্তারিত উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়নে যে বাধাসমূহ পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সবিস্তারে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়সমূহের একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। কেবল মানবেতর অবস্থা থেকে নারীর মুক্তি বা নারী উন্নয়নের জন্যই নয়, তখন সকল সমস্যার সমাধানে প্রধান ও প্রথম ধাপ হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ সমস্যা পরিবেশ বিপর্যয়, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, দারিদ্র্য বিমোচন বা নিরক্ষরতা যাহোক না কেন, নব্বই দশকে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক পর্যায়ের সকল সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। রিও ডি জেনিরোতে ধরিত্রী সম্মেলন, ভিয়েনায় মানবাধিকার সম্মেলন, কায়রোতে জনসংখ্যা সম্মেলন, কোপেন হেগেনে সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন এবং বেইজিং এ নারী সম্মেলনে আলোচ্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বার বার এ প্রসঙ্গটিই এসেছে।
নারীর ক্ষমতায়ন : নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নারী বস্তুগত ও মানবিক সম্পদের উপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, পিতৃতন্ত্র এ সকল প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সকল কাঠামোয় নারীর বিরুদ্ধে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশে নারীর অধিকার ও রাজনৈতিক মণ্ডলে তাদের অংশগ্রহণ তেমন পরিলক্ষিত হয় না। এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পিছনে নানাবিধ কারণ পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো;
১. পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ : বাংলাদেশের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শুধু পুরুষ নয়, সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারীও এ মূল্যবোধ ধারণ এবং অনুশীলন করে। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে নারীকে অধস্তন ও পুরুষকে প্রাধান্য বিস্তারকারী হিসেবে দেখতে চায়। পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণে তৈরি হয় বিভিন্ন মূল্যবোধ। মূল্যবোধ তৈরিতে এ প্রয়োজন পূরণই সূচক হিসেবে কাজ করে।
২. বৈষম্যমূলক অবস্থান : পিতৃতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে মূল্যবোধ তৈরি করা হয় সেখানে নারীকে নিকৃষ্ট এবং পুরুষকে উৎকৃষ্ট ভাবা হয় । তাই জন্মমাত্রই মেয়ে শিশুকে ছুঁড়ে দেয়া হয় বৈষম্যমূলক অবস্থানে।
৩. নারীর অংশগ্রহণহীনতা : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, সমস্যা মোকাবিলা ও সমাধানে নারীর অংশগ্রহণ অপ্রয়োজনীয় ভাবা হয়, যাতে করে নারী পুরুষের কর্মকাণ্ডে ভাগিদার না হতে পারে। এভাবেই নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা এবং পছন্দমতো পেশা বেছে নিতে দেয়া হয় না।
৪. আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা : নারীরা যাতে সম্পদশালী না হতে পারে সেজন্য যতটুকু সম্পত্তি তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পায়, ততটুকুও গ্রহণ করা অনুচিত বলে প্রচার করা হয়। নারীদের স্বাবলম্বী ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কোনো মূল্যবোধ তৈরি করা হয় না। বিরাজমান মূল্যবোধ তাই নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে রাখে।
৫. উত্তরাধিকার আইনে সমতার অভাব : বাংলাদেশে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পায় নারী, হিন্দু আইনে নারী কিছুই পায় না। এক্ষেত্রে সম্পত্তি লাভে নারীর প্রতি চরম বৈষম্য করা হয়েছে। শর্তসাপেক্ষে পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার নারীর জীবনকে বিষিয়ে তোলে। নারী নির্যাতিত হলেও তার তালাকের অধিকার নেই।
৬. মৌলবাদ : মৌলবাদীরা ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো নেতৃত্বেই নারীকে মেনে নিতে পারে না। তারা সর্বত্র একজন পুরুষ এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়। তারা নিকৃষ্টতম বিদ্বেষ ও নিয়মকানুন দ্বারা নারীসমাজকে পর্যুদস্ত করতে চায়। নারীরা যখনই পুরুষের আর্থিকসহ সকল প্রকার নির্ভরশীলতা থেকে
মুক্ত হতে চায়, তখনই এরা ফতোয়ার মাধ্যমে তাদের কোণঠাসা করে রাখে।
৭. কুটিরশিল্প ধ্বংস : কুটিরশিল্প ধ্বংসের মাধ্যমে নারীর কাজের আর প্রাকৃতিক জ্ঞান ব্যবহারের ক্ষেত্র নস্যাৎ করে দেয়। কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের পূর্বে নারী বীজ সংরক্ষণ ও নির্বাচনের কাজটি করত। এছাড়া নারীর শরীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে আধুনিকায়নের টার্গেটে পরিণত হয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার নারী।
৮. বাজার অর্থনীতি : বাজার অর্থনীতি নারীর অবস্থানকে দিনের পর দিন অবনত করছে। একদিকে বাজারে নারী তার স্বল্প দক্ষতা ও স্বল্প পুঁজি নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না। অন্যদিকে, দারিদ্র্যের কারণে পুরুষরা পরিবার ত্যাগ করে শহর অভিমুখী হওয়ায় নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিবারগুলোর বেশিরভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সেই সাথে বাজার অর্থনীতির পণ্য হিসেবে ব্যবহারের বর্ধিত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা দেশ জুড়ে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার একটি কারণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ পরিলক্ষিত হয়। কেবল বিশ্ব সম্মেলন নয়, বাংলাদেশেও স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পরিসরে যে কোনো নীতি নির্ধারণী আলোচনায় নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশজুড়ে নারী হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন ক্রমশ
বেড়েই চলেছে। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার মধ্য দিয়েই নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে। আর নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা চিহ্নিত করে ক্ষমতায়নের উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।