প্রতিবেদনের ধাপসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা, একটি প্রতিবেদন তৈরিতে কি কি বিষয় অনুসরণ করা হয়? আলোচনা কর।
অথবা, একটি উত্তম প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে কি কি ধাপ অনুসরণ করা হয়ে থাকে?
অথবা, একটি ভালো প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রতিবেদন তৈরি গবেষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ । গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত গবেষণার বিষয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যে কোনো বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য হলো নতুন তথ্যের অবতারণা এবং পুরনো তথ্যের সংস্কার। প্রতিবেদনের মাধ্যমে জ্ঞানের আদান-প্রদান সম্ভব। একটি প্রতিবেদন তৈরিতে কয়েকটি ধাপ অনিবার্যভাবে অতিক্রম করতে হয় ।
প্রতিবেদনের ধাপসমূহ : গবেষণা প্রতিবেদনের ধাপ সম্পর্কে কোনো সর্বজন স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। তবে গবেষণা প্রতিবেদনে যে ধাপগুলো অনিবার্যভাবে প্রয়োজন হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো : Goode and Hatt প্রতিবেদনের তিনটি মৌলিক ধাপের উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এসব ধাপের উপধাপেরও আলোচনা করেছেন। যথা :
ক. প্রারম্ভিক অংশ : প্রতিবেদনের প্রারম্ভিক অংশসমূহ হলো নিম্নরূপ :
শিরোনাম : প্রতিবেদনের শিরোনাম সুন্দর, সাবলীল, সহজ, সুস্পষ্ট, সংক্ষিপ্ত ও প্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে। শিরোনাম এমন হবে যেন, এক পলক দেখেই বুঝা যায় গবেষণার বিষয় কি। এজন্য অবশ্য প্রতিবেদনের শিরোনামের মধ্যে গবেষণার সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন হয় না ।
গবেষক ও প্রতিষ্ঠানের নাম : শিরোনামের নিচে গবেষক বা গবেষকদের নাম এবং প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা লিখতে হয় । প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানা সংক্ষিপ্তাকারে লেখা যেতে পারে। কোন জার্নালে প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করলে গবেষকের নামের সাথে পদবি, প্রতিষ্ঠানের নাম ইত্যাদি জার্নালের নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী লিখতে হয়। আবার থিসিসে যে ডিগ্রির জন্য থিসিস লেখা হয়েছে, সে ডিগ্রির নাম উল্লেখ করতে হয় এবং থিসিস জমা দেওয়ার সাল বা তারিখ উল্লেখ করতে হয়।
মুখবন্ধ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সাধারণত গবেষণা প্রতিবেদনে মুখবন্ধ লিখতে হয়। তবে থিসিসে এবং ছোট আকারের গবেষণা প্রতিবেদনে মুখবন্ধ না লিখলেও চলে । জার্নালে প্রকাশের জন্য লিখিত গবেষণা প্রবন্ধে মুখবন্ধ লিখতে হয় না। মুখবন্ধের সাথে ভূমিকার মৌল পার্থক্য হলো, ভূমিকায় থাকে সমস্যাটি নির্বাচনের কারণ, সমস্যাটির প্রকৃতি, পরিধি এবং প্রধান উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। থিসিসের ক্ষেত্রে মুখবন্ধের শেষ অংশ কিংবা পরবর্তী পৃষ্ঠায় কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়। গবেষণা পরিচালনা ও প্রতিবেদন লেখার ব্যাপারে গবেষক যাদের পরামর্শ, সাহায্য, সহযোগিতা ও আর্থিক আনুকূল্য বা অনুদান পেয়েছেন, তাঁদের ঋণ স্বীকার করেন। কিন্তু অপরদিকে, জার্নালে প্রকাশের জন্য লেখা গবেষণা প্রবন্ধে সাধারণত প্রথম পৃষ্ঠার পাদদেশে বা প্রবন্ধের শেষ অংশে পাদটীকার সাহায্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয় ।
সূচিপত্র : থিসিস বা বড় আকারের গবেষণা প্রতিবেদনে সূচিপত্র লিখতে হয়। আবার খুব ছোট আকারের কোনো প্রতিবেদনে কিংবা জার্নালে প্রকাশিতব্য কোনো গবেষণা প্রবন্ধের সূচিপত্র লিখতে হয় না। বস্তুত একটি থিসিসে বা বড় গবেষণা প্রতিবেদনের সূচিপত্রে অধ্যায়গুলোর নাম এবং সম্ভব হলে উপঅধ্যায়ের নাম বা সেকশনগুলোর নামসহ লিপিবদ্ধ করা হয় এবং পাশাপাশি পৃষ্ঠা নম্বরও দেওয়া হয়। সূচিপত্রে সাধারণত ভূমিকা বা তাত্ত্বিক কাঠামো বা সমস্যার বিবরণ, বা নতুন | গবেষণার ক্ষেত্র ইত্যাদি বিবৃত হয়। এছাড়াও সারণি তালিকা, চিত্র তালিকা, গ্রন্থপঞ্জি ও পরিশিষ্টের উল্লেখ থাকে ।
খ. মূল অংশ : প্রতিবেদনের মূল অংশসমূহ নিম্নরূপ :
ভূমিকা : ভূমিকা কিংবা গবেষণার সমস্যার বর্ণনা থেকেই প্রতিবেদনের মূল অংশ শুরু হয়। সাধারণত এখান থেকেই পৃষ্ঠা নম্বর শুরু হয় । এর পূর্বের পৃষ্ঠার ক্ষেত্রে রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। প্রতিবেদনের ভূমিকায় থাকে গবেষণার সমস্যা, প্রকল্প বা অনুমান এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি সম্বন্ধে সঠিক, সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ । গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ, প্রত্যয় বা পরিমাপের সঠিক বা কার্যকরী সংজ্ঞা এ অধ্যায়ে প্রদান করা হয়। গবেষকের গবেষণাভুক্ত সমস্যার সাথে পূর্বে কোনো গবেষণার সম্পর্ক থাকলে সে সম্পর্কেও পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হয়। এ অধ্যায়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক গুরুত্বের বিষয়টিও উপস্থাপন করা হয় ।
গবেষণা পদ্ধতি : প্রতিবেদনের এ অংশে গবেষণার তথ্যসংগ্রহের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয় । গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনার নির্বাচন পদ্ধতি, আকার এবং বৈশিষ্ট্যাবলি এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এতে গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং উপাত্ত সংগ্রহের উপকরণের উল্লেখ করা হয়। আবার গবেষণার পরিকল্পনা বা নকশা এবং গবেষণায় ব্যবহৃত তথ্য গাণিতিক পদ্ধতিরও উল্লেখ করা হয় ।
ফলাফল : গবেষণা প্রতিবেদনের এ অধ্যায় বা অনুচ্ছেদে সংগৃহীত উপাত্তসমূহকে বিভিন্ন তথ্য গাণিতিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে সেগুলোর সংক্ষিপ্তসার ছক বা চিত্রের সাহায্যে উপস্থাপন করা হয় । উপাত্ত উপস্থাপনের বিভিন্ন কৌশল রয়েছে এবং আরও নতুন নতুন কৌশল সংযোজিত হচ্ছে। এসব কৌশল থেকে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় কৌশল অবলম্বন করা হয় । গবেষক ফলাফলকে যত সহজ ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেন, তত পাঠক এর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। গবেষণার ফলাফলের নির্ভরযোগ্য ও যথার্থতা সম্পর্কিত তথ্য প্রমাণও প্রতিবেদনের অংশে উপস্থাপন করা হয় ।
সময় আলোচনা ও সুপারিশ : এ অনুচ্ছেদে গবেষণার ফলাফলের চূড়ান্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয় । ফলাফল কোনো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে সমর্থন করে, বা নতুন কোনো মতবাদের জন্ম দেয়। আবার যদি গবেষণাটি কোনো বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য পরিচালিত হয়ে থাকে, তাহলে সে সমস্যা সমাধানে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সুপারিশমালা লিপিবদ্ধ করে। তাছাড়া এখানে কোনো অসম্পূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনাও হয়ে থাকে ।
সারাংশ : গবেষণা প্রতিবেদনের প্রথমে কিংবা থিসিসের শেষ অংশে সারাংশ হিসেবে গবেষণার ফল লিপিবদ্ধ করা হয়, যাতে পুরো গবেষণাটি না পড়েও সারাংশ থেকে এর ধারণা লাভ করা যায়। তাই এ অংশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় । জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের জন্য অবশ্যই সারাংশ লিখতে হয় ।
গ. নির্দেশিকা : প্রতিবেদনে নিম্নোক্ত নির্দেশিকা দেওয়া হয় :
প্রাসঙ্গিক গ্রন্থপঞ্জি : গবেষণা প্রতিবেদনে বিভিন্ন পত্রপি ও সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং বইপুস্তক, অপ্রকাশিত থিসিস কিংবা বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়। এসব বইপত্র এবং প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রতিবেদন, থিসিস কিংবা গবেষণামূলক প্রবন্ধ ইত্যাদির লেখকের নাম বর্ণমালা অনুসারে উল্লেখ করতে হয়। প্রত্যেক লেখকের নামের সাথে তাঁর বই বা প্রবন্ধের নাম, প্রকাশকের নাম, প্রকাশনার স্থান এবং সাল ইত্যাদি উল্লেখ করতে হয়।
পরিশিষ্ট : গবেষণার যেসব তথ্য প্রমাণ এবং উপকরণ প্রতিবেদনের মূল অংশে সংযোজন করা সম্ভব হয় না সেগুলো পরিশিষ্টে সংযোজন করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে যারা ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চান এগুলো তাদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে পারে ।
উপসংহার : গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে যদিও নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, তবুও উল্লিখিত ধাপসমূহ অপরিহার্যভাবে চলে আসছে । প্রয়োজনে এসব ধাপ ছাড়াও বিভিন্ন ধাপের ব্যবহার করা যেতে পারে। যেক্ষেত্রে যে বিষয়টি করণীয়, সেক্ষেত্রে সেটা প্রয়োগের মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদনকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব।