পোষক-পোষ্য সম্পর্ক বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের কারণ বর্ণনা কর।

অথবা, পোষক-পোষ্য সম্পর্ক কী? বাংলাদেশে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, পোষক-পোষ্য সম্পর্ক কাকে বলে? বাংলাদেশে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের কারণগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
যে কোনো দেশের বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক চলে আসছে।পোষক-পোষ্য সম্পর্কের মূল কারণ হলো অর্থ। গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ভিত্তি মূলত একজন ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ভর করে। পোষক-পোষ্য সম্পর্ক মূলত দ্বিমুখী। একজন পোষ্যের তুলনায় একজন পোষক আবার পোষক অন্য আরেক জনের পোষ্য। অর্থাৎ গ্রাম বাংলার প্রায় সকল মানুষই কোনো না কোনোভাবে পোষক-পোষ্য সম্পর্কে আবদ্ধ।
পোষক-পোষ্য সম্পর্কের সংজ্ঞা : সাধারণভাবে বলতে গেলে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক হচ্ছে সামাজিক অবস্থান পদমর্যাদাগত পার্থকের সম্পর্ক। অসম পদ-মর্যাদার ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক লেনদেনের উপর ভিত্তি করে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তাকে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক বলে। গ্রামীণ সমাজে ভূ-স্বামীর নিকট ভূমিহীন শ্রমজীবী মানুষ তাদের আনুগত্য ও সেবা প্রদানের বিনিময়ে কেবল কর্মসংস্থান বা জমি বর্গা পাওয়ার আশা করে না, বরং তাদের সংকটময় মূহূর্তে পোষকের নিকট নিরাপত্তা লাভের আশা করে থাকে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী পোষক-পোষ্য সম্পর্ককে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে তাঁদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
Erick G. Jansen এর মতে, “পোষক-পোয্য সম্পর্ক হলো মানুষের মধ্যে পদমর্যাদাগত পার্থক্য।”
Powell এর মতে, “পোষক-পোষ্য সম্পর্ক হচ্ছে এক ধরনের সম্পর্ক যে সম্পর্কের মধ্যে তুলনা অযোগ্য পণ্য এবং সেবার বিনিময় হয় দুইটি ভিন্ন পদমর্যাদার অসম আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে।”
James C Scott এর মতানুসারে, “পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পোষক আশ্রিত সম্পর্ককে এক বিশেষ ধরনের দ্বিপক্ষীয় বন্ধন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যা এমন এক যান্ত্রিক বন্ধুত্ব যেখানে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি তার নিজের প্রভাব ও সম্পাদিত কোনো নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করে তার কাছ থেকে বিনিময়ে সাহায্য সমর্থন সেবাযত্ন পেয়ে থাকে।”
পোষক-পোষ্য সম্পর্কের কারণ : বাংলাদেশের গ্রামঞ্চলে কৃষি পেশার উপর ভিত্তি করে এক ধরনের পোষক-পোষ্য সম্পর্ক টিকে আছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের পোষক-পোষ্য সম্পর্ক নিয়ে অনেক সমাজবিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন।তারা পোষক-পোষ্য সম্পর্কের উৎপত্তি, বিকাশ ও টিকে থাকার কারণ উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী এরিক জি. জেনসেন (Erick G. Jansen) গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের কয়েকটি কারণ চিহ্নত করেছেন। কারণগুলি হচ্ছে (১) সম্পত্তির বহুমূখী উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, (২) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, (৩) ভূমির স্বল্পতা ও অসম বণ্টন, (৪) কর্মসংস্থানের অভাব ও জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, (৫) রাজনৈতিক বা জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজন ও (৬) সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থপ্রাপ্তির প্রত্যাশা। উপর্যুক্ত কারণগুলিকে সমন্বিত করে বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে পোষক-পোষ্য সম্পর্কের কারণ উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করা হলো।
১. অসম ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা : গ্রাম প্রধান কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার পোষক-পোষ্য সম্পর্ক নির্ধারণের অন্যতম নিয়ামক বা উপাদান হচ্ছে ভূমি। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের সমাজে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জমির মালিক পোষক শ্রেণির অধীনে পোষ্য শ্রেণির সাধারণ কৃষকগণ বর্গা জমি চাষ ও দাদন জমি চাষের মত প্রচলিত রীতির মাধ্যমে দুই শ্রেণির মধ্যে এক ধরণের নির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরি হয়। এ নির্ভরশীল সম্পর্ককে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ভূমিহীন পোষ্যদের সংখ্যাই বেশি। ভূমিহীন পোষ্যদের সংখ্যা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্রামীণ সমাজে ভূমির অসম বণ্টন রয়েছে। অল্প সংখ্যক ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি রয়েছে অন্যদিকে অসংখ্য ভূমিহীন কৃষক। ভূমিহীন কৃষকেরা জীবনযাপনের জন্য ভূমি মালিকের যে কোনো শর্তে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।
২. সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ : বাংলাদেশে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক টিকে থাকার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের চরম বিকাশের ফলে কিছু মানুষের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ হয়েছে আর অধিকাংশ মানুষ সম্পদহীন। ফলে সম্পদশালীদের দখলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। অন্যরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে মাত্র। বাংলাদেশের গ্রামগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়।গ্রামের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ তাদের পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্য গ্রামের সম্পদশালী ব্যক্তিদের দারস্থ হয়। এ জন্য গ্রামের দরিদ্র্য জনগণ সম্পদশালী ব্যক্তিদের সাথে অসম সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। সম্পদশালী ব্যক্তিরা নিজেদের প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করে।
৩. সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা : কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে ভূমির মালিকানা একজন ব্যক্তির শুধু আয় বা সম্পদ বাড়ায় না তার সাথে সাথে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয়। সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার উপর ভিত্তি করে সামাজিক রীতিনীতি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, শিক্ষা ও প্রশাসনিক যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। যা একজন ব্যক্তিকে পোষক হিসেবে সমাজের, পোষ্যকুলের উপর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির নিরঙ্কুশ প্রভাব বজায় রাখতে সহায়তা করে। এ প্রেক্ষিতে রবার্ট ডাল (Robert Dhal) বলেন, “কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজে একজন ব্যক্তির ভূমির
মালিকানা তার পদমর্যাদা, শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এবং রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক দক্ষতা, পতিপত্তি নির্ধারণ করে।” এ মন্তব্যটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ।
৪. গ্রামীণ জনপ্রতিনিধি : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক শ্রেণির লোকেরাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। পোষক শ্রেণি সমাজকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে রাখেন যেখানে সম্পদহীন পোষ্য শ্রেণির কোনো সুযোগ থাকে না জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার পোষ্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তাই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার স্বার্থের গ্রামীণ সমাজে পৌষক-পোষ্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখেন। আর পোষ্য শ্রেণিরা গ্রামীণ
জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সামান্য সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য লাভের আশায় আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে পোষক-পোষ্য সম্পর্কটি আরো মজবুত হয় এবং টিকে থাকে।
৫. সামাজিক নিরাপত্তা : সামাজিক নিরাপত্তা ধারণার কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। গ্রামীণ সমাজে পাড়া-মহল্লা ও গ্রামভিত্তিক জনপ্রতিনিধিত্ব প্রচলিত। আবার একাধিক পোষকের মধ্যে ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি বিদ্যমান থাকে। প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের মধ্যে দ্বন্ধ প্রকাশ্য। স্বার্থ ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার দ্বন্ধ প্রতিযোগিতার স্বপক্ষে জনসমর্থন ধরে রাখতে তারা মরিয়া হয়ে থাকে। এ দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থায় পোষ্যগণ তাদের মধ্যে অধিকতর ক্ষমতাবান প্রভাবশালী পোষকের ছত্রছায়ায় থাকতে নিরাপধবোধ করে। মিথ্যা মামলা ও হয়রানি চলতে থাকে।এসব থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পোষ্য শ্রেণি পোষকদের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এখনো গ্রাম অঞ্চলে সুদূর পরাহত।
৬. গতানুগতিক নেতৃত্বের ভূমিকা : বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে এখনো গতানুগতিক নেতৃত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।সেখানে বংশানুক্রমিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। এ গতানুগতিক নেতৃত্ব গ্রামের প্রান্তিক কৃষক, শ্রমজীবী সহজ-সরল সাধারণ পোষ্য শ্রেণির নেতৃত্ব প্রদান করে। যার মাধ্যমে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক স্থায়ী রূপ লাভ করে। এ গতানুগতিক নেতৃত্ব পোষ্যের সম্মানের চেয়ে আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। তাই সাধারণ পোষ্যশ্রেণি পোষকদের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে চলে। ফলে একটি অসম আনুগত্যশীল পোষক-পোষ্য সম্পর্ক বলবৎ থাকে।
৭. পোষ্য শ্রেণির অসচেতন আচরণ : গ্রামের পোষ্য শ্রেণির মানুষ সমাজের যে কোনো বিষয়ে গভীরভাবে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবে না। তারা যে কোনো বিষয়ে আপাততকে গুরুত্ব প্রদান করে। আবার কোনো কিছু না পাওয়াকে অদৃষ্টের পরিহাস হিসেবে মেনে নেয়। নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য খুব একটা প্রচেষ্টা থাকে না । ফলে সামাজিক সুবিধাগুলো উচ্চ শ্রেণিই কুক্ষিগত করে ফেলে । সামাজিক সুবিধা প্রাপ্তির ফলে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও উচ্চ শ্রেণির জন্য বরাদ্দ মনে করা হয়। পোষক শ্রেণি সচেতন শ্রেণি হওয়ায় পোষকগণ তাদের চিরাচরিত কর্তৃত্ব প্রভাব অটুট রাখতে সক্ষম হয়। এভাবে সমাজে পোষক-পোষ্য ধারণা বিদ্যমান থাকে।
৮. দারিদ্র্য ও অভাব : দারিদ্র্য পোষক-পোষ্য শ্রেণি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। গ্রামীণ সমাজে মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির উপর অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সংখ্যাগরিষ্ট দরিদ্র্য শ্রেণি নির্ভরশীল। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ধনী ব্যক্তিরাই গ্রহণ করে দরিদ্র্য শ্রেণির উপর চাপিয়ে দেয়। দরিদ্র্য শ্রেণির স্বাধীন কোনো ভূমিকা নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ধনী শ্রেনীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে দরিদ্র্য শ্রেনীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নিজ শ্রেনীর উপর তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় না। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক টিকে থাকার মূলকারণ হলো সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অবস্থা। সমাজে পোষ্য শ্রেণি অর্থনৈতিকভাবে পোষক শ্রেণির চেয়ে দুর্বল। এ দুর্বলতার কারণে তারা আবহমানকাল ধরে পোষক শ্রেণির পোষ্য হয়ে আছে। মূলত সমাজে এ শ্রেণির টিকে থাকার পশ্চাতে অন্যতম কারণ হলো সম্পদের অসম বণ্টন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*