পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের পিছনে কী কী কারণ ক্রিয়াশীল? আলোচনা কর।
অথবা, কী কারণে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে? আলোচনা কর।
অথবা, পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণগুলো বর্ণনা দাও।
অথবা, পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পিতৃতন্ত্র এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে পুরুষ নারীর উপর প্রভুত্ব করে, নির্যাতন চালায় এবং নারীকে শোষণ করে। পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি পুরুষ প্রাধান্য, সমাজের সর্বক্ষেত্রে পুরুষ প্রভুত্ব বিস্তার করে. রেখেছে এবং নারীকে অধস্তন ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করেছে। পিতৃতন্ত্র এমন পরাক্রমশালী যে, নারী সকল নির্যাতন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণ : পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। নিম্নে পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
১. প্রজননের পার্থক্য : পিতৃতন্ত্রের উদ্ভবের একটি ব্যাখ্যা এই যে, প্রজননে নারী-পুরুষের ভূমিকায় প্রভেদ। প্রজনন সমাজের উদবর্তনে অতি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, সমাজ প্রজনন ছাড়া টিকতে পারে না। কিন্তু প্রজননে পুরুষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। সন্তান ধারণ ও সন্তান জন্মদান নারীর সাথে সম্পৃক্ত। সমাজের স্থিতি ও সংরক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যক প্রজননের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকায় পুরুষ বিচ্ছিন্নতার বিষণ্ণ মনোবেদনায় ভুগত।
২. সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় : বিচ্ছিন্নতার বিষণ্নতা হতে মুক্তির জন্য পুরুষ পিতৃত্বের ধারণার সৃষ্টি করেছিল। সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে পিতৃত্ব একান্ত অপরিহার্য, এমন ধারণার সৃষ্টি করে প্রজননে নারীর ভূমিকার বাস্তবতাকে গৌণ করে ফেলা হয়েছিল। এভাবে প্রজননে নারীর ভূমিকাকে আড়ালে রেখে পিতৃত্বকে সমাজের স্থিতি ও সংরক্ষণে মুখ্য চালিকাশক্তি বলে উপস্থাপিত করে পুরুষ নারীর উপর নিজ কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।
৩. যৌনতা : কেউ কেউ যৌনতা (Sexuality) কে পিতৃতন্ত্রের উৎপত্তির কারণ হিসেবে দেখেছেন। নারীর দেহসৌষ্ঠব তার নিজস্ব, কিন্তু পুরুষ তা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের ভোগের বস্তুতে রূপান্তরিত করেছে। যৌনতাকে পুরুষ একটি উদ্দিষ্ট বস্তুরূপে পরিণত করেছে।
৪. নারীকে ব্যবহার করে দাস হিসেবে : পুরুষ নারীকে দাস হিসেবে ব্যবহার করে। পুরুষ কর্মসম্পাদন করে। সে কর্তৃকারক, (Subject) নারীর উপর কর্মসম্পাদন করা হয়। সে কর্মকারক, (Object) এভাবে যৌনতার ভাষাকে পুরুষের কর্তৃত্বের ও একচেটিয়া কর্মকাণ্ডের বাহন করা হয়েছে। যৌন মিলনে নারীর ভূমিকা গৌণ, নিজের সন্তুষ্টি নয়, পুরুষের সন্তুষ্টি বিধান নারীর যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য।
৫. নারী ও প্রকৃতির সমরূপতা : প্রকৃতির উপর পুরুষের আধিপত্য থেকে পিতৃতন্ত্রের উৎপত্তি বলে অনেকে অনুমান করে। প্রকৃতির উপর আধিপত্যের আনুষঙ্গিক হিসেবে পুরুষ নারীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। জীবনধারণের জন্য বৃহত্তর প্রকৃতির সাথে ক্ষুদ্রতর মানবগোষ্ঠীর সম্পর্ককে মানুষ মূল্য দিত। তখন সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, প্রকৃতি যেমন ছিল জীবনধারণের সঙ্গী, বন্ধু, নারী তেমনি প্রজন্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবন তথা প্রকৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে বন্ধু ছিল ।
৬. মানব সম্প্রদায়ের উদবর্তন : শুরুতে মানব সম্প্রদায়ের উদবর্তন ছিল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। কালক্রমে নারীর উপর প্রভুত্বের নানা সুবিধা সম্পর্কে পুরুষ অবহিত হলো এবং নিজেকে সর্বেসর্বা, আইন প্রণেতা, বিচারক, আদেশদাতা, রক্ষাকর্তা এবং প্রভু হিসেবে আত্মসন্তুষ্টি লাভের জন্য নারীর উপর আধিপত্য জোরদার করে তুললো। পিতৃতন্ত্রের চরম রূপ তখন প্রকট হয়ে উঠলো।
৭. উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন : উৎপাদন অ্যাপ্রোচের (Modes of production) মধ্যে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব নিহিত রয়েছে। পিতৃতন্ত্র যে ধরনের পরিবার, গৃহ ও যৌনতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা পরিবর্তনশীল উৎপাদন অ্যাপ্রোচের ফল। পিতৃতন্ত্র পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর ফল এবং উৎপাদন সম্পর্ক পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের নিয়ামক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রকৃতির উপর আধিপত্যের আনুষঙ্গিক হিসেবে পুরুষ নারীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। আদিম মানুষ প্রকৃতির সাথে শান্তিতে সহাবস্থান করতো। জীবনধারণের জন্য বৃহত্তর-প্রকৃতির সাথে ক্ষুদ্রতর মানবগোষ্ঠীর সম্পর্ককে মানুষ মূল্য দিত। তবে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভবের কারণ যাহোক, নারীনির্যাতন পিতৃতন্ত্রের বিশেষ একটি দিক। নারীকে নির্যাতনের শৃঙ্খলমুক্ত করে নারী ও পুরুষকে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন ও উন্নয়নে সমঅংশীদারিত্বে উদ্বুদ্ধ করা উইমেন্স স্টাডিসের মূল কথা। এ মৌলিক লক্ষ্যের মধ্যেই জ্ঞানের এ শাখার সংজ্ঞা নিহিত আছে। সমাজের স্থিতি ও সংরক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যক প্রজননের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকায় পুরুষ বিচ্ছিন্নতার বিষণ্ন মনোবেদনায় ভুগত।