পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে লিখ ।
অথবা, পরিসংখ্যানের দুর্বল দিকসমূহ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, পরিসংখ্যানের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য সর্বপ্রথম পরিসংখ্যান বা ‘Statistics’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। ক্রমে ক্রমে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে ইউরোপে মানব কল্যাণে ব্যবহৃত বিষয়াদির উপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যান বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার তথ্য প্রদান ও সংগ্রহের কাজে বিশেষ বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা : বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যায় পরিসংখ্যানের বহুল ব্যবহার এবং প্রয়োগ সত্ত্বেও এর কতকগুলো অসুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরিসংখ্যানের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য এদের সংক্ষিপ্তআলোচনা নিম্নে দেয়া হলো :
১. পরিসংখ্যান সংখ্যাভিত্তিক উপাত্তের উপর নির্ভরশীল : পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা দ্বারা প্রকাশিত তথ্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা যায় না এমন তথ্যের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করা যায় না। মূলত পরিসংখ্যান পদ্ধতিগুলো সংখ্যাভিত্তিক তথ্যের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। অতএব, পরিসংখ্যান পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগ শুধু সংখ্যাত্মক পর্যালোচনা বা যেসব ঘটনাকে সঠিকরূপে সংখ্যায় প্রকাশ করা যায় সেসব তথ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ।
২. পরিসংখ্যানে সরাসরি গুণবাচক তথ্যাবলি ব্যবহৃত হয় না : গুণবাচক চলকগুলো সরাসরি সংখ্যায় প্রকাশ করা যায় না। যেমন- স্বামী-স্ত্রীকে ভালোবাসে, কিন্তু কতটুকু ভালোবাসে তা সংখ্যাভিত্তিক পরিমাপ করা যায় না। এ ধরনের তথ্য সঠিক সংখ্যার আকারে প্রকাশ করা যায় না। বহু গুণগত চলক রয়েছে, যেমন- কোম্পানির আকার, পণ্যেরন গুণগতমান, নৈপুণ্য, মেধা ও শ্রমিকের দক্ষতা ইত্যাদি । উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে আনুমানিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যায় রূপান্তর করে বিভিন্ন পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ধরা যাক, অদক্ষ শ্রমিককে ১, আধা দক্ষ শ্রমিককে ২ এবং দক্ষ শ্রমিককে ৩ ইত্যাদি । গুণগত চলককে সঠিকভাবে সংখ্যায় প্রকাশ করতে না পারলে যথার্থ ফলাফল পাওয়া যাবে না।
৩. পরিসংখ্যান পুঞ্জীভূত তথ্যের বিশ্লেষণ : পরিসংখ্যান পুঞ্জীভূত বা সমষ্টিগত তথ্যের বিশ্লেষণ করে এবং সামগ্রিক ফলাফলের উপর আলোকপাত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু সঞ্চয়ের অথবা ঋণের পরিমাণ হতে জনসাধারণের সঞ্চয়ের গড় প্রবণতা অথবা গড় ঋণ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। এটা ব্যক্তি বিশেষের সঞ্চয়কে প্রকাশ করে না অথবা ব্যক্তিগত ঋণগ্রস্ততার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে না। পরিসংখ্যান এ ধরনের ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে পারে না। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান সামগ্রিক একটা ধারণা প্রদান করে।
৪. কোন স্বতন্ত্রকে পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে না : পরিসংখ্যান কোন একক সংখ্যা বা বিচ্ছিন্ন সংখ্যাকে পর্যালোচনা বা একক কোন সংখ্যার উপর সাধারণত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা প্রয়োজন হয় সে পরিস্থিতিতে পরিসংখ্যান পদ্ধতিসমূহ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। পরিসংখ্যান স্বতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ না করে শুধুমাত্র সমষ্টির গড় ফল প্রকাশ করে।
৫. পরিসংখ্যান পদ্ধতিসমূহ গড় বিবেচনায় সত্য : কোন অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদিকে পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করলে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা কেবল উক্ত তথ্যাদির গড় বিবেচনায় সত্য। কেননা পরিসংখ্যান কোন একক বা বিচ্ছিন্ন তথ্যাদিকে বিশ্লেষণ করে না। পরিসংখ্যানে অন্যান্য বিজ্ঞানের মত কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ একক ও নির্ভুল ফলাফল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পরিসংখ্যান শুধু গড় এবং সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে ফলাফল দেয়। এ কারণে পরিসংখ্যানিক তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করা হয় তার প্রাপ্ত ফলাফল গড় বিবেচনায় সত্য ।
৬. পরিসংখ্যান বিধিগুলো পরিবর্তনশীল : পরিসংখ্যান বিধিগুলো শুধু দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে সত্য। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়মগুলোর প্রকৃতি অপরিবর্তনীয়, কিন্তু পরিসংখ্যান বিধিগুলোর প্রকৃতি পরিবর্তনশীল। পরিসংখ্যান গড়, আসন্ন মান ও সম্ভাব্যতার পরিভাষায় প্রকাশিত হয়। বিষয়টির প্রকৃতিই এটাকে সম্পূর্ণভাবে সঠিক হতে দেয় না, অর্থাৎ কোন একটি ঘটনা
বহুসংখ্যক কারণ দ্বারা প্রভাবিত বিধায় পরিসংখ্যান পদ্ধতিগুলোর মানও পরিবর্তনশীল।
৭. পরিসংখ্যান তথ্যের পরিপূর্ণতা প্রকাশ করে না : মূলত পরিসংখ্যান পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে জটিল তথ্যাদি সহজ, সরল এবং সংক্ষিপ্তরূপে উপস্থাপন করা হয়। এ কারণে তথ্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না। কেননা পরিসংখ্যান পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করে যে ফলাফল পাওয়া যায় তা গড় বিবেচনায় সত্য বলে তথ্যের পরিপূর্ণতা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশে অক্ষম।
৮. পরিসংখ্যানিক উপাত্তে ভুল থাকলে : পরিসংখ্যানের তথ্যাদি অভিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যথায় অনভিজ্ঞ লোকের মাধ্যমে সংগৃহীত এবং সংরক্ষিত উপাত্তে ভুল থাকতে পারে। যার কারণে সঠিক পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলেও প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ভুল সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। এ কারণে কোন অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যটি সফল হয় না।
৯. ভুল ব্যাখ্যাকরণ : তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোন বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে হয়। এক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ ও অসতর্কতার সাথে প্রাপ্ত ফলাফল ব্যাখ্যায়িত হলে ভুল সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এ কারণে পরিসংখ্যানে ফলাফল বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যাকরণকেও অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় ।
১০. পরিসংখ্যানিক সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক নয় : পরিসংখ্যানে নমুনায়নের মাধ্যমে তথ্যবিশ্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। নমুনায়ন একটি পদ্ধতি যা বৃহৎ আকারের তথ্য সমষ্টি হতে ক্ষুদ্র আকারের কিছু তথ্য নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে উক্ত তথ্যবিশ্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে বুঝায়। কোন তথ্যবিশ্ব হতে একই আকারের অনেকগুলো নমুনা সংগ্রহ করা যায় এবং প্রায় প্রত্যেকটি নমুনার মান দ্বারা নিরূপক তথ্যবিশ্বের কোন বৈশিষ্ট্যকে পরিমাপ করলে আলাদা আলাদা ফলাফল পাওয়া যায়। আবার তথ্যবিশ্বের সকল উপাদানকে গণনায় নেয়া হয় না, ফলে তথ্যবিশ্বের কোন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরিসংখ্যান দ্বারা শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব।
১১. পরিসংখ্যানের অপব্যবহার উদ্দেশ্যমূলক অপব্যবহার অথবা সংগত ব্যবহারের ফলে পরিসংখ্যান হতে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উদ্দেশ্যমূলক অপব্যবহার উপাত্ত সংগ্রহ এবং সেগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যাকরণ এ উভয় স্তরেই হতে পারে। কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনদাতা নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ভুল তথ্য উদ্ধৃত করতে পারে । উপযোগী পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া পরিসংখ্যানের প্রয়োগ হতে অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের উদ্ভব হতে পারে। এক উদ্দেশ্যে সংগৃহীত উপাত্ত সম্পর্কহীন অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, পরিসংখ্যানে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা দক্ষতার সাথে দূর করার মাধ্যমে একে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা যায় ।