নেতৃত্ব বলতে কী বুঝ? সামাজিক ঐক্য ও সংহতিতে নেতৃত্বের ভূমিকা আলোচনা কর ।

অথবা, “উপযুক্ত নেতৃত্ব মানেই হচ্ছে একটি জাতির উন্নয়ন”- বিশ্লেষণ কর।
অথবা, নেতৃত্ব কী? জাতি গঠনে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, “উপযুক্ত নেতৃত্ব মানেই হচ্ছে একটি জাতির উন্নয়ন” ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নেতৃত্ব কাকে বলে? জাতি গঠনে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
অথবা, নেতৃত্বের সংজ্ঞা দাও। জাতি গঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, নেতৃত্ব বলতে কী বুঝ? জাতি গঠনে নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নেতৃত্ব প্রদান করা। প্রতিটি রাষ্ট্রে বা সমাজে কেউ না কেউ নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। একজন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যখন কোনো দলকে অথবা কোনো জনসমষ্টিকে পরিচালনা করে থাকে তখন তাকে নেতা বলা হয়। আর তার জনসমষ্টিকে পরিচালনা করার বিশেষ গুণ বা ক্ষমতাকে নেতৃত্ব বলা হয় । একটি জাতির জীবনে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ।
নেতৃত্ব : সাধারণ কথায় নেতৃত্ব হচ্ছে, যে কোনো সংঘবদ্ধ দলকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার এমন একটি শক্তিশালী কৌশল, যাতে দলীয় সদস্যরা তাদের সর্বাধিক সামর্থ্য অনুযায়ী উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে দলীয় লক্ষ্যার্জনে তৎপর হয়।এককথায় বলা যায় যে, সব কাম্য গুণ একজন বা একদল ব্যক্তিকে সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য উদ্দীপ্ত করতে পারে তাকে নেতৃত্ব বলে অর্থাৎ নেতৃত্ব হলো একটি সামাজিক গুণ।
শাব্দিক অর্থে : ইংরেজি Leadership শব্দের বাংলা রূপ হচ্ছে নেতৃত্ব। নেতৃত্ব কথাটির সাথে নেতা (Leader) এবং কর্তৃত্ব বা আধিপত্যের বিষয়টি জড়িত। নেতৃত্ব হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যা মূলত কোনো পরিস্থিতিতে নেতা ও অনুসারীদের সামগ্রিক সম্পর্কের ফলশ্রুতি।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
এম. জে. গ্যানন (M. J. Gannon) এর মতে, “নেতৃত্ব হলো প্রভাব বিস্তারকারী নেতা একটি নির্দিষ্ট কার্যধারা সম্পন্ন করতে তার অধীনস্থদের অবশ্যই প্ররোচিত প্রক্রিয়া বা প্রভাবিত করে।”
কিথ ডেভিস (Keith Davis) বলেছেন, “Leadership is the process of encouraging and helping others to work enthusiastically tourned objectives.”
কিমবল ইয়ং (Kimball Young) বলেছেন, “নেতৃত্ব হচ্ছে আধিপত্য বিস্তারের এমন একটি রূপ, যা সদস্যবর্গ কমবেশি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে থাকে। নেতৃত্বের দ্বারা এ সদস্যবর্গ প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত থাকে।” (Leadership is that form of dominance which is more or less willingly accepted by the members who are influenced or controlled.)
সুতরাং উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি যে, নেতৃত্ব হচ্ছে কোনো দলকে পরিচালনা করা এমন একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন প্রতিনিধি তার অধীনস্থদেরকে সম্ভাব্য সর্বাধিক যথার্থতা অনুযায়ী উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে। নেতৃত্ব সকল সময় সকল অবস্থাতেই অনুসারীদের আচরণকে প্রভাবিত করার একটি প্রক্রিয়া।
জাতি গঠনে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা : জাতি গঠনে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা : গোষ্ঠীর ভিতরের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা হচ্ছে নেতার অন্যতম কাজ । নেতার কাজ গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে প্রভাবিত করে গোষ্ঠীর খুঁটিনাটি বিষয়ের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করা।
২. সমন্বয়সাধন করা : গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপের সাথে গোষ্ঠীর সমন্বয় সাধন নেতাকেই করতে হয়। গোষ্ঠীর কার্যকলাপের খোঁজখবরও নেতাকে রাখতে হয়। নেতাকে সবসময় গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট থাকতে হয় । সংহতি সৃষ্টিতে নেতৃত্বের ভূমিকা তথা নেতার কার্যাবলি অপরিসীম
৩. পিতৃত্ব : সদস্যরা নেতৃত্বদানকারী নেতাকে পিতা বলে মনে করে। ‘সমাজস্থ ব্যক্তির অনুভূতি ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হলো নেতা। সে কারণে সদস্যরা মনে করেন নেতৃত্বদানকারী নেতাই হলো যোগ্য ব্যক্তি, যার সাথে তারা একাত্মতা অনুভব করতে পারে।
৪. প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ : দলের সদস্যদের পক্ষে নিজস্ব দল ছাড়া অন্য দলের সদস্যদের সাথে যেহেতু মুখোমুখি মিলিত হওয়া সম্ভব নয়, সে কারণে নেতাকেই দল বহির্ভূত সম্পর্ক ঠিক রাখার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। এভাবে সকল দল বা গোষ্ঠীর নেতার সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক ঐক্য সৃষ্টি হয়।
৫. ন্যায়বিচার : নিজস্ব কোন্দল ও বিবাদ মীমাংসার জন্য শালিসির মাধ্যমেও মধ্যস্থতা করা। নিরপেক্ষ বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শুধু কলহ বিবাদ মীমাংসা করাই নয়, সে সাথে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজও নেতাকে করতে হয়।
৬. নিয়ম নীতিনির্ধারণ : নিয়ম নীতিনির্ধারণের মাধ্যমেই কোনো দল বা গোষ্ঠী তার নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। বেশিরভাগ সময় গোষ্ঠীর নেতাই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যকে নির্ধারণ করে থাকেন। তিনি যখন মনে করেন, বিশেষ কোনো কর্মপন্থা দল বা গোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের জন্য উপযোগী।
৭. দলগত ঐক্য : নেতৃত্বের এমন কতকগুলো উপাদান লক্ষ্য করা যায়, যেগুলোর মাধ্যমে গোষ্ঠী বা দলের কাছে তাদের ঐক্যের দিকটি বড় হয়ে যায় এবং দলের সদস্যরা নিজেদেরকে একাত্ম অনুভব করে। যেমন- নাম, পোশাক, পরিচয় জ্ঞাপক চিহ্ন ইত্যাদি। দলের ঐক্যবোধকে দলের সদস্যদের কাছে শক্তিশালী করে তোলে।
৮. মনোবল সৃষ্টি : আজকের যুগের সফল নেতার অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে দলীয় মনোবল সৃষ্টি করা। গোষ্ঠী বা দলের সদস্যদের কাজ এবং লক্ষ্য যাতে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে সেদিকে তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন এবং নেতা সকল সময় দলীয় সদস্যদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব অনটন, মনোভাব ইত্যাদির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
৯. সমস্যা সমাধান : সামাজিক ঐক্য ও সংহতিকে সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখার জন্য যে কোনো ধরনের সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য নেতাকে সবার আগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। যেমন- যৌতুক একটি সামাজিক সমস্যা।
১০. সংগঠনকারী ও প্রশাসক : একজন যোগ্য সংগঠনকারী ও প্রশাসক হিসেবে নেতার তথা নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনেক। নেতৃত্বদানকারী নেতা তার সামাজিক ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টিকারী সহায়ক কর্মসূচিগুলো সংগঠনের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করে থাকেন ।
১১. রিলিফ ও সাহায্য বণ্টন : একজন নেতৃত্বদানকারী নেতা তার নিজস্ব এলাকায় সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বিপদকালীন সাহায্য সহযোগিতা ও সরকারি রিলিফ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করার চেষ্টা করে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করে থাকেন।
১২. শিক্ষা : নেতা গ্রামে তথা বসবাসকৃত এলাকায় নিরক্ষর মানুষদেরকে অক্ষরজ্ঞান দান করার জন্য বয়স্ক শিক্ষা, গণশিক্ষা ইত্যাদি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। যা জাতি গঠনে নেতার অন্যতম একটি অবদান বলে স্বীকৃত।
১৩. কৃষি উন্নয়ন : একজন নেতার সূক্ষ্ম দৃষ্টি কৃষির উন্নয়নের উপরেও থাকে। তিনি সবসময় চিন্তা করেন কৃষির উন্নয়ন
ঘটিয়ে কিভাবে জাতীয় উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তিনি সরকারের কাছ থেকে কৃষি ভর্তুকির ব্যবস্থা করারও চেষ্টা করেন।
১৪. বৈদেশিক সাহায্য : একজন নেতা সবসময় দেশের তথা জাতির আর্থিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করেন। এ হিসেবে তিনি বৈদেশিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক সাহায্য দেশের উন্নয়নের নিমিত্তে আসছে।
১৫. দুর্নীতি দমন : উন্নত জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় একজন নেতার অন্যতম কাজ হচ্ছে দুর্নীতি দমন করা। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন খুবই ঘোলাটে, এখানে নেতা নেত্রীরা জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে সম্পদের যে পাহাড় গড়ছে, তা আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাসকে দুর্নীতির ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের ভিতর ঠেলে দিচ্ছে।একজন উৎকৃষ্ট নেতা জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত করে জাতি গঠনে তথা জাতির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
১৬. কল্যাণমূলক কাজ : বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণের জন্য বহুবিধ কার্য নেতাকে সম্পাদন করতে হয়। এসব জনকল্যাণমূলক কাজে যাদের বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান, তারা হচ্ছেন নেতৃত্বদানকারী নেতা।
১৭. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। সে কারণে পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য পুরানো ধ্যানধারণা ও অভ্যাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। তাই পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য যোগ্য নেতৃত্বদানকারী নেতার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, নেতৃত্ব হচ্ছে মানুষকে প্রভাবিত করার মতো একটি অপরিহার্য ক্ষমতা। সাংগঠনিক যে কোনো প্রকার কাজের জন্য নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি অথবা বেসরকারি যে কোনো প্রকারের কাজই হোক না কেন তার কৃতকার্যতা ও লক্ষ্য অর্জন সুষ্ঠু নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। নেতা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই নেতৃত্ব ফলপ্রসূ হয়। আলোচনার পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উন্নত জাতি গঠনে অর্থাৎ জাতির উন্নয়নে সুষ্ঠু ও যোগ্য নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*