Answer

নারী শিক্ষার বিস্তারে বেগম রোকেয়ার গৃহীত পদক্ষেপগুলো কী কী?

অথবা, নারী সমাজে শিক্ষার প্রসারে রোকেয়ার পদক্ষেপ সংক্ষেপে তুলে ধর।
অথবা, নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে বেগম রোকেয়া কী কী কৌশল অবলম্বন করেন?
অথবা, নারী শিক্ষা বিস্তারে রোকেয়ার কর্মকাণ্ড তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম শ্রদ্ধার সাথে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলার নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী আন্তরিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি, নারীমুক্তির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার কূপমণ্ডূক মুসলমান নারীসমাজকে তিনিই সর্বপ্রথম মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তিনিই প্রথম মুক্তিপথে বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। এ কারণে তিনি মুসলিম বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে আলোর দিশারী হয়েও থাকবেন।
নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার গৃহীত পদক্ষেপ : মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে যে কুসংস্কার,রূপমণ্ডূকতা ও অবনতির কারণগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে প্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল, তা একমাত্র শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমেই দূর করা যেতে পারে একথা বেগম রোকেয়ার কাছে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই ছিল সত্য। অন্তর দিয়ে তিনি এ সত্য উপলব্ধি রেছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় এ সত্যও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়। দেশের বিপুল জনসমষ্টির অর্ধেক নারী। এ বিপুল, জনসমষ্টিকে অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে জাতির উন্নতি সাধন অলীক কল্পনামাত্র। সমাজের উন্নতি সাধনের জন্য শুধু পুরুষ সম্প্রদায় নয়, নারী সম্প্রদায়েরও উন্নতি সাধন প্রয়োজন। একই সমাজের দুই অপরিহার্য অঙ্গ নারী ও পুরুষ।পুরুষের বিকাশ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নারীর বিকাশ। তিনি এ সত্য অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে নারীসমাজের উন্নতি সাধনের জন্য স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
১. ভাগলপুরে মুসলিম বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় : বেগম রোকেয়া বাংলায় মুসলমান নারী সম্প্রদায়ের অধঃপতিত অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হয়েছিলেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে মুসলিম নারীসমাজের জাগরণের জন্য তিনি শিক্ষা প্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে ভাগলপুরে মুসলিম বালিকাদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেন। এ স্কুলটি স্থাপিত হয় ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবরে। দুর্ভাগ্যক্রমে সপত্নী, কন্যা ও জামাতার কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতা আসার কারণে তিনি স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
২. সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল : বেগম রোকেয়া ১৯০৯ সালের শেষের দিকে ভাগলপুর ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ তারিখে নতুন উদ্যমে স্বল্পসংখ্যক ছাত্রী নিয়ে ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ক্লাস শুরু করেন। ১৯৩০ সালের মধ্যেই বেগম রোকেয়ার অসাধারণ কর্মপ্রচেষ্টায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
৩. মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন : বেগম রোকেয়ার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপনের পিছনে সক্রিয় ছিল একটি আদর্শ একটি প্রেরণা। এস্কুলের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রীর অভাব।প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষয়িত্রীর অভাবে শিক্ষাদান কাজে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর বার্ষিক রিপোর্টে মুসলিম মহিলা শিক্ষয়িত্রীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন জানিয়ে আসছিল। অবশেষে সরকারের
ঔদাসীন্যের অবসান হয়। সরকার ১৯১৯ সালের শেষভাগে কলকাতায় একটি মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করেন।
৪. বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সম্মিলনী : বেগম রোকেয়া মুসলমান বালিকাদের শিক্ষার দুরবস্থা, স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে মুসলমান সমাজে প্রতিকূল মনোভাব এবং প্রাণঘাতী অবরোধ প্রথার কুপ্রভাব সম্পর্কে ১৯২৬ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সম্মিলনীতে প্রদত্ত সভানেত্রীর অভিভাষণে তিনি বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করে তাদের প্রতিকূল মনোভাব দূর করার চেষ্টা করেছেন।
৫. বিদেশের শিক্ষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন : স্বদেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে বেগম রোকেয়া জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অন্তরের ঐ একই প্রেরণা তিনি বিবার শিক্ষা আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।
৬. মুসলিম মহিলা সমিতি : বিশ শতকের প্রথমদিকে নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ ‘স্থাপিত হয়। মুসলমান নারীসমাজের পশ্চাৎপদতার কারণগুলো বেগম রোকেয়া তাঁর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলমান নারীসমাজের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যেসব কুপ্রথা ও কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা প্রচলিত আছে, সেগুলো দূরীভূত করে মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের মহতি উদ্দেশ্যে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসিলম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার জীবনব্যাপী সাধনার অন্যতম বিশিষ্ট ক্ষেত্র ছিল এ সমিতি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, তিনি মুসলমান নারীসমাজের অধঃপতিত অবস্থা দূর করার জন্য শিক্ষার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি একজন রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের মেয়ে হয়েও সমস্ত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে যেভাবে নারী জাগরণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তা চিরস্মরণীয়। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার নাম ইতিহাসে পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!