নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ কি? নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়াসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ ও নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়াসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ বলতে কী বুঝ? নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়াসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ কী? নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়াগুলোর বিবরণ দাও।
অথবা, নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ কী? নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়াসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পিতৃতন্ত্রের মূল কথা পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা। নির্যাতন চালিয়ে এবং নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে পুরুষ নারীকে পুরুষ আধিপত্য মেনে নিতে এবং পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। পিতৃতন্ত্র ও নারী নির্যাতন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নারীকে নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শন করে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সংরক্ষণ করা হয়। ইংরেজিতে Oppression এবং Violence দু’টি শব্দ আছে। শব্দ দুটি বুঝাতে বাংলায় নির্যাতন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। নির্যাতনে দু’টি পক্ষ থাকে— একজন নির্যাতন করে, অপরজন নির্যাতন ভোগ করে। নির্যাতন দৈহিক হতে পারে, মানসিকও হতে পারে। কাউকে দৈহিক কষ্ট দেয়া, কাউকে প্রহার করা কিংবা কাউকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়া, কাউকে পদে পদে খোটা দেয়া উভয়ই নির্যাতন।
নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ : নারী নির্যাতনের ব্যাপক রূপ থেকে নির্যাতনের সংকীর্ণ রূপের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখে কিছু কল্যাণকর কর্মকাণ্ডের দ্বারা নারী প্রগতি সাধনের উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। নিম্নে নারী নির্যাতনের
ব্যাপক রূপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নারী নিজের জন্য কাজ করে না : ‘নারী নিজের জন্য কাজ করে না, সে কাজ করে স্বামী, সন্তান ও পরিবার পরিজনের জন্য। আদর্শ নারী হচ্ছে পতিপ্রাণা। সে স্বামী ও সন্তানের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবে। পরিবারের জন্য আত্মবিসর্জন, আত্মত্যাগ আদর্শ নারীর বৈশিষ্ট্য। নারী পরিশ্রম করবে, ফলভোগ করবে স্বামী-সন্তান, পরিবার পরিজন। নিজের জন্য নারী কিছু করবে না, করার অধিকার তার নেই। সংসারের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ নারী স্বামী সন্তানের পরিচর্যায়
নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেবে।
. অর্থনৈতিক মূল্য না থাকা : গৃহের চার দেওয়ালের মধ্যে নারী উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীর দৈহিক মেহনতের পরিমাণ পুরুষ অপেক্ষা অনেক বেশি। কিন্তু তবু নারীকে নিষ্কর্মা, পরগাছা মনে করা হয়। কারণ নারীর কর্মের কোন অর্থনৈতিক মূল্যও দেয়া হয় না। তাকে সর্বতোভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল মনে করা হয় এবং তার পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।
৩. নারীর নিজের পরিচয় নেই : নারীর নিজের পরিচয় নেই, স্বামী বা সন্তানের নামে তার পরিচয়। পুরুষের অধীনতাপাশে আবদ্ধ নারীকে পরিবার, ঘর সংসার, আত্মীয়স্বজন বা বাইরের জগৎ, বৃহত্তর ব্রহ্মাণ্ডের কোন ব্যাপারে নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কর্মসম্পাদনের স্বাধীনতা দেয়া হয় না। নারীদেহ নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পুরুষের, এটাই হল পিতৃতন্ত্রের ভিত্তি।
৪. নির্যাতন ভীতি প্রদর্শন : নারীর গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিরূপণের প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরুষ এ অধিকার প্রয়োগ করে। নারীর দেহ নারীর সম্পদ এবং নারীর সম্মতি ছাড়া তার দেহের উপর কারও কোন অধিকার নেই। এ বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার প্রয়োজনে পিতৃতন্ত্র নারী নির্যাতন তথা নির্যাতনের
ভীতি প্রদর্শনের আশ্রয় নেয়।
৫. নারীর অবরুদ্ধ জীবনযাপন : পিতৃতন্ত্রে নারী-পুরুষের অধীনে গৃহে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতে বাধ্য। ঘরের বাইরে পা ফেলার অধিকার তার নেই। সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। বস্তুত সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে নারী অদৃশ্য ও নির্বাসিত।
৬. পুরুষকে নারীর উপর স্থান : পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে পুরুষের চেয়ে হীন, নিচ, নিকৃষ্ট জ্ঞান করা হয়। সমাজ সৃষ্ট পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোকে সদগুণ এবং নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোকে চারিত্রিক ত্রুটি গণ্য করে পুরুষকে নারীর উপর স্থান দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে Elizabeth Cady Stanton তাঁর ‘The Woman’s Bible’ (P-60) গ্রন্থে বলেছেন,”Violence and its corollary fear serve to terrorize females and to maintain the patriarchal definition of women’s place.” নির্যাতন ও তার আনুষঙ্গিক ভীতির দ্বারা নারীকে আতঙ্কিত করে রাখা হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থানকে সুদৃঢ় করা হয়।
নারী নির্যাতন প্রক্রিয়া : নারীসমাজের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন বিভিন্ন পন্থায় সংঘটিত হয়ে থাকে। নারী নির্যাতন প্রক্রিয়ার সাথে সার্বিক নির্যাতন প্রক্রিয়ার মিল আছে। নিম্নে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া উল্লেখ করা

হল ঃ
১. মতাদর্শ : পুরুষ প্রাধান্য নারী নির্যাতনের আদর্শিক ভিত্তি। অবিবেচক, হঠকারি, বিচারবুদ্ধি বিবর্জিত, ভাবাবেগ তাড়িত, অস্থিরচিত্ত নারীকে নিজ ইচ্ছায় চলতে দিলে সমাজে বিপর্যয় ঘটে থাকে। কাজেই সমাজের প্রয়োজনে নারীকে বশে রাখতে হবে। নারীকে বশে রাখতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যদি নির্যাতনের প্রয়োজন পড়ে তবে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে, সমাজের সার্বিক কল্যাণের প্রয়োজনে নির্যাতন অপরিহার্য। কাজেই নারী নির্যাতন আদর্শের জন্য নির্যাতন।
২. প্রচারণা : নারী নির্যাতন মতাদর্শ সমাজে গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে ধর্ম, শিক্ষা ও পরিবারে নিরবচ্ছিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও নভেল– এমনকি বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে নারীর হীনতা ও অধীনতা এবং পুরুষের আধিপত্য নানাভাবে প্রচার করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
৩. বাছবিচারহীন ও অনৈতিক : বয়স, স্থান, কাল নির্বিশেষে সকল নারী বস্তুত নির্যাতনের সম্ভাব্য লক্ষ্য। নাবালিকা শিশু কন্যাকে শৈশবে নির্যাতনের শিকার হতে হয় খাদ্য ও চিকিৎসায় বৈষম্যের মাধ্যমে। চীনে কোমলমতি বালিকার পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতা পরানো হয়। পুরুষ প্রধান সমাজ নারী নির্যাতনে যে খারাপ কিছু আছে তা মনে করে না।
৪. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মান্যতা : ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও সংস্কার নারীর মধ্যে হীম্মন্যতা সঞ্চার করেছে, সে নির্যাতনকে আত্মস্থ করে নিয়েছে। সবল স্ত্রী রুগ্ন, অক্ষম স্বামীর হাতে মার খেয়েও প্রতিবাদ করে না, কারণ সে মনে করে স্বামীর কাছ থেকে প্রহার তার প্রাপ্য। সমাজ নারীর মধ্যে এমন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মান্যতা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, শাশুড়ি বধূকে পীড়ন করার
জন্য পুত্রকে প্ররোচিত করে।
৫. নির্যাতনকারী ও নির্যাতিত : পুরুষ নির্যাতন করার অধিকারী এবং নির্যাতন সহ্য করা নারীর কর্তব্য। এ বোধ জাগ্রত করে নারীকে প্রতিবাদ বা প্রতি আক্রমণ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। পুরুষ নির্যাতনকারী এবং নারী নির্যাতনের নীরব শিকার এ যেন চিরন্তন নিয়ম। সবল স্ত্রী দুর্বল স্বামীর প্রহার খেয়ে পাল্টা প্রহার করে না, স্বামীর গঞ্জনার জবাব দেয়া স্ত্রী বেয়াদবি মনে করে।
মূল্যায়ন : নারীকে পুরুষের অধীনতা পাশে আবদ্ধ রেখে নারীর উপর পুরুষের সর্বময় প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য পিতৃতন্ত্রের অস্ত্র নারী নির্যাতন। একে মূল্যায়ন করা যায় এভাবে প্রথমত, আমাদের সমাজে প্রতিটি নারী সদাসর্বদা নির্যাতনের আতঙ্কে ভোগে। এমনকি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মার্কিন নারীরা নির্যাতনের ভয় থেকে মুক্ত নয় দ্বিতীয়ত, স্ত্রীকে প্রহার মানবতা বিরোধী এমন অপরাধবোধ স্বামীর কদাচিৎ থাকে। এমনকি, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষককে নিরপরাধী এবং নারীকে প্রকৃত অপরাধী সাব্যস্ত করার উদাহরণ বিরল নয়। তৃতীয়ত, আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে নারী নির্যাতন এমনভাবে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে এবং সেগুলো নিয়ে বাস্ করতে আমরা এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এ নির্যাতনগুলোকে আমাদের চোখে সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে- হয়। ব্যাপক নির্যাতন হিসেবে ধরা পড়ে না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, উল্লিখিত ব্যাপক রূপ থেকে নির্যাতনের সংকীর্ণরূপের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখে কিছু কল্যাণকর কর্মকাণ্ডের দ্বারা নারী প্রগতি সাধনের উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে নির্যাতনের রূপগুলোর মূলোৎপাটন না করলে নারীমুক্তি আসবে না। নারী ও পুরুষের জেন্ডার সুষম ও সমতাপূর্ণ
বিকাশ ঘটবে না।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*