নারী নির্যাতনের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ ।

অথবা, নারী নির্যাতনের উপর একটি প্রবন্ধ রচনা কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের বিশদ বর্ণনা দাও।
অথবা, কিভাবে সমাজে নারী নির্যাতন করা হয়? বিবরণ দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা :
দৈহিক ও মানসিকভাবে নারী নির্যাতনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। খবরের কাগজের পাতায় নারী ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের জন্য নিগ্রহ, পিতৃতন্ত্রের মূল কথা গুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা। নির্যাতন চালিয়ে এবং নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে পুরুষ নারীকে পুরুষ আধিপত্য মেনে নিতে এবং পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। পিতৃতন্ত্র ও নারী নির্যাতন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নারীকে নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শন করে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা হয়। নির্যাতন দৈহিক হতে পারে, মানসিকও হতে পারে।নারীর নীরবতা নারী নির্যাতনের ঘটনার সাধারণ্যে প্রকাশে প্রতিবন্ধক। মেয়েদের নির্বাক ও নিষ্ক্রিয় থাকার শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে রাখা হয়েছে।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা : নারী নির্যাতনের এ যাবৎকালের সমাজতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাইরে বর্তমান সময়ে যে ভয়ঙ্কর ধারা লক্ষ্য করা গেছে, সেগুলো নিম্নরূপ :
১. শিশু হত্যা ও ধর্ষণ : শিশু হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সংঘটিত শিহাব, নওশীন, তৃষা, বাপ্পী, হৃদয়, ডন ও রত্নার হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ শোকে মুহ্যমান, ক্ষুব্ধ, উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। এরা প্রত্যেকেই শিশু। এ সুন্দর পৃথিবীকে ভালোভাবে দেখার, উপলব্ধি করার পূর্বেই তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সব মায়েরা এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখন বাংলাদেশে প্রতিমাসে খুন হচ্ছে প্রায় ৩৯টি শিশু।
২. ভয়াবহতা : নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্য অপরাধ ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও খুন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে ধারা বা প্রবণতা অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেছে তা উপরে মোটামুটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারার মধ্যে আরও লক্ষণীয় দিক হল নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা। যেমন- গণধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণধর্ষণের পরে নারীর বাঁচার সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়া হচ্ছে।
৩. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা: ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য নারী নির্যাতনের এ হীন কৌশলটি অধিক ব্যবহৃত হয়েছে। ছবিরানী মন্ডলের ঘটনা, রাজশাহীর মহিমাসহ অসংখ্য নৃশংস বর্বরোচিত ঘটনা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে, রাজনৈতিক নেতাদের ক্যাডার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। রাজনীতিতে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী পালনের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তার খেসারত বা মূল্য অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র জাতিকেই দিতে হবে।
৪. ধর্ষণ নিয়ে বাণিজ্য : রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার মহিমার ধর্ষণের ছবি তোলার খবর এবং হাটের দিনে উক্ত ছবির স্টিল ফটোগ্রাফ প্রদর্শনের খবর আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ধর্ষণের ভিডিও করে ব্লু-ফ্লিম তৈরি করা এ বাংলাদেশেই শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর পূর্বে। ধর্ষণ নিয়ে এ বাণিজ্য করার প্রবণতা ১০ বছর পূর্বেও বাংলাদেশের সমাজ মানসিকতায়
ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
৫. গ্লোবালাইজেশন : গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে কর্মসংস্থানের লোভে পড়ে নারী ও শিশু যেভাবে পাচার হচ্ছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে বাংলাদেশের নারী বিক্রি হচ্ছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধের প্রভাব নারীসমাজের উপর পড়তে বাধ্য।
৬. নারীবাদী সংগঠন : নারীবাদী বিভিন্ন সংগঠন নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার চিত্র তুলে ধরে। সমতাপূর্ণ, সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়েই এ সংগঠনের পথ চলা। কিন্তু সন্ত্রাসী রাজনীতির শিকার নারীর আজকের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি। নারী ভিন্ন গ্রহের কোন প্রাণী নয়, নারী মানুষ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম,শ্রম ও মেধা।
৭. মূল্যবোধের অবক্ষয় : নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ পুরানো বিষয় হলেও উল্লিখিত ধারাগুলো সাম্প্রতিক প্রবণতা, যা সমাজের ভিতরের মূল্যবোধের অবক্ষয়কে উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দেয়। মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার ধর্ষণ এখন আর পুরুষতান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক কোন গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণের ঘৃণ্য হাতিয়ার।
৮. ইয়াসমিনসহ চাঞ্চল্যকর নারী হত্যা মামলা : রাষ্ট্র কর্তৃক ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বিচার দাবি, সীমা চৌধুরীকে জেলখানায় ধর্ষণ ও হত্যার বিচার দাবি করতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সবসময়ই সোচ্চার ছিল। যে কোন নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ নারী পরিষদ প্রতিবাদ জানাতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও আপসহীনভাবে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছে।
৯. নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শন : নারীর গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিরূপণের প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরুষ এ অধিকার প্রয়োগ করে। নারীর দেহ, নারীর সম্পদ এবং নারীর সম্মতি ছাড়া তার দেহের উপর কারও কোন অধিকার নেই— এ বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার প্রয়োজনে পিতৃতন্ত্র নারী নির্যাতন তথা নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শনের আশ্রয় নেয়।
১০. অর্থনৈতিক মূল্য না থাকা : গৃহের চার দেওয়ালের মধ্যে নারী উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীর দৈহিক মেহনতের পরিমাণ পুরুষ অপেক্ষা অনেক বেশি। কিন্তু তবু নারীকে নিষ্কর্মা, পরগাছা মনে করা হয়। কারণ নারীর কর্মের কোন অর্থনৈতিক মূল্যও দেয়া হয় না। তাকে সর্বতোভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল মনে করা হয় এবং তার পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।
১১. নারী নিজের জন্য কাজ করে না : নারী নিজের জন্য কাজ করে না। সে কাজ করে স্বামী, সন্তান ও পরিবার পরিজনের জন্য। আদর্শ নারী হচ্ছে পতিপ্রাণা। সে স্বামী ও সন্তানের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবে। পরিবারের জন্য আত্মবিসর্জন, আত্মত্যাগ আদর্শ নারীর বৈশিষ্ট্য। নারী পরিশ্রম করবে ফলভোগ করবে স্বামী সন্তান, পরিবার পরিজন। নিজের জন্য নারী কিছু করবে না, করার অধিকার তার নেই। সংসারের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ নারী স্বামী সন্তানের পরিচর্যায় নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেবে।
মূল্যায়ন : নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্য অপরাধ ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও খুন। নারী নির্যাতনকে এভাবে মূল্যায়ন করা যায়—
প্রথমত, সন্ত্রাসী রাজনীতির সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক মন্দা, অবাধ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যখন সমাজে প্রকটভাবে দেখা দেয় তখন বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে হীন ও নিকৃষ্ট জ্ঞান করা হয়। এ প্রসঙ্গে Elizabeth Cady Stanton তাঁর The Woman’s Bible, (P-66) গ্রন্থে বলেছেন, “Violence and its corollary bear serve to terrorize females and to maintain the patriarchal definition of women’s place.” নির্যাতন ও তার আনুষঙ্গিক ভীতির দ্বারা নারীকে আতঙ্কিত করে রাখা হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থানকে সুদৃঢ় করা হয়। তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে প্রতিটি নারী সদাসর্বদা নির্যাতনের আতংকে ভোগে। এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মার্কিন নারীরা নির্যাতনের ভয় থেকে মুক্ত নয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রত্যাশা আলোকিত মানুষ সত্যকে সত্য, আলোকে আলোকিত ও অন্যায়কে চিহ্নিত করে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিকারের ও প্রতিরোধের আন্দোলন আরও সক্রিয়ভাবে নিজেদের সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ হবে। ব্যাপক অর্থে নির্যাতনের রূপগুলোর মূলোৎপাটন না করলে নারীমুক্তি আসবে না। নারী ও পুরুষের জেন্ডার সুষম ও সমতাপূর্ণ বিকাশ ঘটবে না। দৈহিক ও মানসিকভাবে নারী নির্যাতনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। খবরের কাগজের পাতায় নারী ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের জন্য নিগ্রহ দেখা যায়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*